ইউক্রেনের রাজধানী কিভের অ্যাকাডেমিকা টুপোলেভা স্ট্রিটের অ্যাপার্টমেন্টের চারতলার ফ্ল্যাটে আমি তখন একা। ২০১৭ সাল থেকে এ দেশে আছি। ডাক্তারির পঞ্চম বর্ষের পড়ুয়া। সঙ্গী বাঙালি বন্ধুটি ইতিমধ্যেই কলকাতায় ফিরে গিয়েছে।
রাশিয়ার আকাশ হানার পরে কিভের একটি সেনা ছাউনির বিধ্বস্ত অবস্থা। ছবি: পিটিআই ।
তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। ঘুম ভাঙল বন্ধুদের ফোনে। মজার ছলেই বলেছিল, ‘জানলা দিয়ে মুখ বার করে দেখ বাইরে কী হচ্ছে।’ চোখ কচলে পর্দা সরাতেই দেখি, বাইরে ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছে। বোমার শব্দ শোনা যাচ্ছে। প্রতি চার-পাঁচ মিনিট অন্তর কাছাকাছি হচ্ছে বিস্ফোরণ। কয়েকটি যেন বেশ কাছেই ফাটল। শহরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বোরিসপিলে বোমা পড়েছে।
ইউক্রেনের রাজধানী কিভের অ্যাকাডেমিকা টুপোলেভা স্ট্রিটের অ্যাপার্টমেন্টের চারতলার ফ্ল্যাটে আমি তখন একা। ২০১৭ সাল থেকে এ দেশে আছি। ডাক্তারির পঞ্চম বর্ষের পড়ুয়া। সঙ্গী বাঙালি বন্ধুটি ইতিমধ্যেই কলকাতায় ফিরে গিয়েছে। টেনশন কমাতে কর গুনতে শুরু করলাম। সকাল ৬টা ১০ মিনিট পর্যন্ত ১৪টা বিস্ফোরণ হয়েছিল। এর পরেই নামল নিস্তব্ধতা।
এর মধ্যেই দরজায় কে যেন নক করছেন। খুলে দেখি আমার অ্যাপার্টমেন্টেরই দু’জন বাসিন্দা। জানালেন, নিকটবর্তী মেট্রো স্টেশনে আশ্রয় নিতে যাচ্ছেন তাঁরা। আমাকে বললেন, আমারও ওঁদের সঙ্গে যাওয়া উচিত। তাঁদের বলে দিলাম, আমি এখানেই থাকছি। পরে শুনলাম, রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা থেকে বাঁচতে মানুষ আশ্রয় নিচ্ছেন কিভের বিভিন্ন মেট্রো স্টেশনে। কারণ, এগুলি মাটির অনেক গভীরে।
প্রতিবেশীদের ‘এখানেই থাকব’ বললেও বুঝলাম, অ্যাপার্টমেন্টে থেকে যাওয়াটা হয় তো নিরাপদ হবে না। ধীরে সুস্থে নিজের ট্রলি ব্যাগে দাঁত মাজার ব্রাশ, পেস্ট, দু’টো জামা, পাসপোর্ট, পড়ুয়াদের জন্য বিশেষ রেসিডেন্সিয়াল কার্ড, মোবাইল চার্জার আর গান শোনার জন্য বড় স্পিকারটা নিয়ে নিলাম। বাকি সব রইল পড়ে। বাড়ি ফেরার টিকিট কাটা ছিল ১৬ মার্চ। হাওড়ার আন্দুলের বাড়িতে মা-দিদি আছেন। ওঁদের দুশ্চিন্তা না-করতে বলে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য পেরেমোহি অ্যাভিনিউ। ঘণ্টাখানেক দূরত্বের ওই এলাকায় থাকেন দিল্লির বাসিন্দা, এক ব্যবসায়ী বন্ধু। ওঁর গাড়ি আছে। প্রয়োজনে সেই গাড়িতে করেই পোল্যান্ডের সীমানায় পশ্চিম ইউক্রেনের শহর লিভিভে যাব আমরা।
রাস্তায় বেরিয়ে বুঝলাম, অ্যাপার্টমেন্ট পুরো ফাঁকা। যত এগোচ্ছি রাস্তায় থিকথিকে ভিড়। মেট্রো স্টেশনে পৌঁছতে বাসে উঠলাম। আজ থেকে বাসভাড়া নেওয়া বন্ধ হল। পথে নামা গাড়ির সংখ্যা আচমকা অনেক বেড়ে গিয়েছে। তীব্র যানজটে
কিছু ক্ষণ আটকে থাকার পরে বাস থেকে নেমে গেলাম। পঁচিশ মিনিট হেঁটে মেট্রো স্টেশনে পৌঁছলাম। এখানেও টিকিটের দাম নেওয়া হল না। ছ’টা স্টেশন পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছলাম। রাস্তায় দেখলাম, সেনাবাহিনীকে টহল দিচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, অনেক আগে থেকেই কিভে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে গিয়েছে রাশিয়ার গুপ্তচর। তাই রাস্তার মোড়ে-মোড়ে সঙ্গের কাগজপত্র খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছিল সেনাবাহিনী।
আসার পথে আর যা দেখলাম, জীবনেও না-ভোলা সেই অভিজ্ঞতা রোমাঞ্চ বাড়িয়ে দিচ্ছিল। এ দেশে আমরা তো অতিথি। কিন্তু নিজের শহর-ঘর ছেড়ে কোলে-কাঁখে পোষ্যকে নিয়ে সব তখন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে রাস্তা দিয়ে ছুটছেন। এটিএমে দাঁড়ালাম টাকা তুলতে। জনা পঞ্চাশেকের পরে যখন সুযোগ এল, তখন টাকা শেষ। ও দিকে সুপার মার্কেটে কেনাকাটার ভিড়ও রাস্তায় নেমে বহু দূর পর্যন্ত চলে গিয়েছে। জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া। অবশ্য ভোর পাঁচটায় উঠে বন্ধু বেশ কিছু জিনিস কিনে এনেছে। এখানে থেকে গেলেও তাতে আমাদের কয়েক দিন চলে যাবে।
সাইবার অ্যাটাক হয়ে গিয়েছে। ফলে অনলাইনে কেনাকাটা বা যাবতীয় লেনদেন বন্ধ। আমি শুধুই এখানকার জাতীয় টেলিভিশনের খবর শুনছি। দেখছি, কী ভাবে ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে বোমা পড়ছে। বেশির ভাগ আক্রমণ চলছে রাস্তা, বিমানবন্দরের মতো সম্পত্তির উপরে। বসত বা অফিস বাড়িতে বিস্ফোরণ হয়নি বলেই শুনছি।
আপাতত যুদ্ধের এই আবহে নিজেকে সামলে রাখার জন্য ভরসা রেখেছি সঙ্গীতে। সকাল থেকে তাই আমার সঙ্গী ‘লিঙ্কিন পার্ক’-এর ওয়ার এবং ‘আস্কিং আলেকজ়ান্ড্রিয়া’র রক।
লেখক ডাক্তারি পড়ুয়া
অনুলিখন: জয়তী রাহা