ইউক্রেনে গ্রাবোভো গ্রামের কাছে ঝোপে পড়ে এক যাত্রীর দেহ। সিটবেল্ট দিয়ে তখনও বাঁধা রয়েছে বিমানের আসনের সঙ্গে। ছবি: এএফপি।
বৃহস্পতিবার বিকেলে যখন ইউক্রেনের মাটিতে আছড়ে পড়ছিল এমএইচ ১৭, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তখন ফোনে বারাক ওবামার সঙ্গে কথা বলছিলেন। ওই বাক্যালাপের মাঝখানে খবরটা আসে। দু’জনের মধ্যে তাই নিয়েও সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা হয়।
শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্টের গলার স্বর কিন্তু বেশ চড়া।
সাংবাদিক সম্মেলন করে ওবামা এ দিন সরাসরি বলেছেন, “এই বিমানটি রুশপন্থীরাই ধ্বংস করেছে। রাশিয়াই এদের অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করছে।” তাঁর স্পষ্ট হুঁশিয়ারি, রাশিয়া যদি ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদত দেওয়া বন্ধ না করে, আমেরিকা তার উপরে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বোঝা আরও বাড়াবে।
মালয়েশীয় বিমানে রুশপন্থী জঙ্গিরাই ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, এই অভিযোগ সবার আগে করেছিল ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। সেটা গত কালের ঘটনা। রুশপন্থীরা আবার পাল্টা বলেছিল, এটা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর কাজ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পরশেঙ্কো সেই অভিযোগ নস্যাৎ করেন। কিন্তু সরাসরি কারও দিকে আঙুল তোলেননি তখনও। রাশিয়া কিছু বলেনি। আমেরিকা এবং ব্রিটেনও যথেষ্ট সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানায়। ফলত বৃহস্পতিবার অন্তত আন্তর্জাতিক মহলে রাশিয়াকে সে ভাবে ছিছিক্কার শুনতে হয়নি।
সাংবাদিক বৈঠকের পথে ইউক্রেনের রুশপন্থী জঙ্গিদের স্বঘোষিত
প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার বোরোদাই (মাঝে)। শুক্রবার। ছবি: এএফপি।
শুক্রবারের ছবিটা কিন্তু তার চেয়ে অনেকটাই আলাদা। গত ২৪ ঘণ্টা ধরে ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তা আন্তন গেরাশচেঙ্কো তাঁর ফেসবুক পেজে যা যা বলে আসছিলেন, এ দিন কার্যত সেই কথাগুলোই সরকারি ভাবে বলেছে ইউক্রেন। আন্তর্জাতিক মহলও সেটাই অনুসরণ করেছে। সুতরাং রাশিয়া তথা পুতিন এ দিন অনেকটাই একঘরে। সিকি শতক পরে ফের ঠান্ডা যুদ্ধের ভ্রুকুটি মস্কোকে ঘিরে।
গোটা ঘটনায় রাশিয়া যে নিজেও ব্যাকফুটে রয়েছে, সেটা প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল এ দিন সকালেই। সারা পৃথিবীর খবরের শিরোনাম ছিল এমএইচ ১৭। কিন্তু রাশিয়ার প্রথম সারির কাগজগুলোতে খবরটা ছিল নীচের দিকে। তার পর সারা দিনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগের সুর যত চড়েছে, রুশ পক্ষের পাল্টা যুক্তি তত দুর্বল শুনিয়েছে।
রুশ সরকারি সংবাদমাধ্যম এ দিন দাবি করছিল, ক্ষেপণাস্ত্রের নিশানা আসলে নাকি ছিলেন পুতিনই। ব্রাজিলে ব্রিকস শীর্ষ বৈঠক সেরে গত কালই দেশে ফিরেছেন তিনি। ওই বিমানপথ দিয়েই ফিরেছেন। পুতিনের বিমান ইলিউশিন ও মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িংয়ের চেহারায় সাদৃশ্যও আছে। রুশ তরফে যুক্তি ছিল, ইউক্রেনের সেনাবাহিনীই পুতিনের বিমানে হামলা চালাতে গিয়ে ভুল করে এমএইচ-১৭-এ আঘাত করেছে। রাশিয়ার সেনাকর্তাদের দাবি, যে ‘বুক’ ক্ষেপণাস্ত্রের কথা বলা হচ্ছে, তা ইউক্রেনের হাতেই বিপুল সংখ্যায় মজুত রয়েছে।
রাশিয়ার এই যুক্তি অবশ্য হালে পানি পায়নি। ইউক্রেনের গেরাশচেঙ্কো কালই দাবি করেছিলেন, রুশ জঙ্গিরা ইউক্রেনের সেনাবিমান টেনে নামাতে গিয়ে এমএইচ ১৭ ধ্বংস করে বসেছে। প্রমাণস্বরূপ রুশপন্থী নেতা ইগর স্ত্রেলকভের একটি বার্তার কথাও উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
বিমান বিপর্যয়ে নিহতদের জন্য প্রার্থনা। শুক্রবার কিয়েভে। ছবি: রয়টার্স।
আজ আবার রুশপন্থী জঙ্গিদের কম্যান্ডার ও রুশ সামরিক গোয়েন্দা দফতরের এক অফিসারের কথাবার্তার টেপও প্রকাশ করেছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের দাবি, ওই কথোপকথন থেকে স্পষ্ট যে, ইউক্রেনের যুদ্ধবিমান ভেবেই হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা।
ইউক্রেনের এই রুশপন্থী জঙ্গিদের সঙ্গে মস্কোর যোগাযোগ নতুন নয়। ইউক্রেনের ক্রিমিয়া গণভোটে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার পর থেকেই ইউক্রেনের অন্যান্য অংশেও রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়েছে। সেই আন্দোলনে রুশ মদতের অভিযোগ নিয়ে বারবারই সরব হয়েছে পশ্চিমী দুনিয়া।
এমনিতে গত কয়েক মাস ধরেই রাশিয়া ও ইউক্রেন পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিমানে হামলা করার অভিযোগ এনে চলেছে। বৃহস্পতিবার সকালেও ইউক্রেনের একটি সামরিক বিমান রাশিয়া ধ্বংস করেছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। সপ্তাহের গোড়ার দিকে এই ইউক্রেন সঙ্কটের জেরেই রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়েছিল পশ্চিমী দুনিয়া। গত কাল ওবামা ও পুতিনের মধ্যে ফোনালাপ সে দিক থেকে এমনিই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। তার মধ্যে এমএইচ ১৭ এসে পড়ে কূটনৈতিক সমীকরণের জটিলতা আরও বাড়িয়ে তুলল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা এ দিন সরাসরিই বললেন, বিমান ধ্বংসের দায় মস্কো এড়াতে পারে না। তাঁর বক্তব্য, “রাশিয়া ক্রমাগত ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব খর্ব করে চলেছে। সঙ্কট
কাটানোর কোনও চেষ্টাই সে করেনি। আমরা এখনও চাই কূটনৈতিক পথেই বিষয়টা মিটুক। কিন্তু তার জন্য পুতিনকে সবার আগে বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করতে হবে।” ওবামা মনে করিয়ে দিয়েছেন, এই উপদ্রুত এলাকায় বিমানে হামলার ঘটনা এই প্রথম নয়।
ওবামা যে এই রকম কড়া বার্তা দিতে পারেন, তার ইঙ্গিত এ দিন সকাল থেকেই মিলছিল। হিলারি ক্লিন্টন মন্তব্য করছিলেন, “পুতিনের বড্ড বাড় বেড়েছে! হি হ্যাজ গন টু ফার!” তার আগে রাষ্ট্রপুঞ্জে মার্কিন রাষ্ট্রদূত সামান্থা পাওয়ার বিবৃতি দিয়ে জানান, এমএইচ-১৭ বিমানে বুক এস-১১ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালানো হয়েছিল। তা পূর্ব ইউক্রেনের কোনও এলাকা থেকে ছোড়া হয়। তাঁর দাবি, মার্কিন ও ইউক্রেনের গোয়েন্দারা ওই হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে একটি এস-১১ মিসাইল লঞ্চার ডনেৎস্ক এলাকার রুশপন্থী জঙ্গিদের হাতে আসার প্রমাণও পেয়েছেন।
সামান্থাই এ দিন এমএইচ ১৭ নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের তরফে প্রথম মুখ খোলেন। তিনি এও দাবি করেন, এস-১১ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার মতো দক্ষতা রুশপন্থী জঙ্গিদের নেই। তাই ‘বাইরের’ কোনও বিশেষজ্ঞ উপস্থিত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ইঙ্গিত স্পষ্টতই রাশিয়ার দিকে। তাঁর কথায়, “রাশিয়া যে ওই জঙ্গিদের ট্যাঙ্ক-সহ নানা অস্ত্রশস্ত্র অনেক দিন ধরেই সরবরাহ করছে, তার প্রমাণ আমরা আগেই নিরাপত্তা পরিষদে পেশ করেছি।” তাঁর দাবি, ডনেৎস্ক এলাকার স্বঘোষিত রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট আলেকজান্দার বোরোদাই-সহ জঙ্গি আন্দোলনের তিন শীর্ষ নেতা রুশ নাগরিক।
এমএইচ-১৭ এখন ৩০ বছর আগের একটি ঘটনার কথা মনে পড়াচ্ছে। ১৯৮৩ সালে আলাস্কা থেকে সোল যাওয়ার পথে কোরিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে হামলা চালিয়েছিল একটি রুশ যুদ্ধবিমান। কোরীয় বিমানটি ভুল করে রুশ আকাশসীমায় ঢুকে পড়েছিল। সে বার তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’-এর অভিযোগ তুলেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন।
কোরীয় বিমানে সে বার মারা গিয়েছিলেন ২৬৯ জন। মালয়েশীয় বিমানে এ বার প্রাণ হারালেন ২৯৮ জন। ঘটনাটা ঠিক কী হয়েছে, তা জানতে ব্ল্যাকবক্স থেকে পাওয়া তথ্যের বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
রুশপন্থী জঙ্গিরা জানিয়েছে, তারা ব্ল্যাক বক্স পেয়েছে। রাশিয়া সেটা নেবে না বলে জানিয়েছে। ইউক্রেনের এখন আশঙ্কা, তথ্য লোপাট করতে ব্ল্যাকবক্স নষ্ট করতে ফেলতে পারে জঙ্গিরা।
রাশিয়ার মদতে জঙ্গিরা বিমান ধ্বংস করেছে। রাশিয়া যত দিন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের
সাহায্য করবে, আমরা আরও বেশি করে নিষেধাজ্ঞা চাপাতে থাকব।—বারাক ওবামা।