দু’দশকের আলোচনা শেষমেশ পরিণতি পেল। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর প্রভাব থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার লক্ষ্যে একমত হল ১৯৬টি দেশ। জন্ম নিল ‘প্যারিস এগ্রিমেন্ট।’
চূড়ান্ত খসড়া পেশ হয়েছিল গত কাল। তার পর ঘণ্টা তিনেকের অপেক্ষা, খসড়া পড়ে দেখার জন্য। অবশেষে শনিবার গভীর রাতে মিল চূড়ান্ত অনুমোদন। প্যারিসে রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চ থেকে সুখবর ঘোষণা করলেন ফরাসি বিদেশমন্ত্রী লরেন ফঁব। হাতের মুঠোয় ধরা পাতার আকারের ছোট্ট হাতুড়ি। ফঁব বললেন, ‘‘হাতুড়িটা ছোট। তবে আমার মনে হয় খুব বড় কাজ করবে এটা।’’ হাততালির শব্দে ভরে উঠল মঞ্চ। উঠে দাঁড়িয়ে প্যারিস চুক্তিকে স্বাগত জানালেন বিশ্বের রাষ্ট্রনেতারা। উষ্ণায়ন রোখার আইনি শর্তে বাঁধা পড়লেন তাঁরা।
চুক্তি সাক্ষরের ঠিক আগের মুহূর্তেও খসড়া নিয়ে টানাপড়েন চলছিল বলে জানিয়েছেন ফঁব। খসড়ার কিছু অংশের ভুল অনুবাদ, কোথাও ভুল বানান, কোথাও আবার ভুল কিছু শব্দের প্রয়োগ নিয়ে কাটাছেঁড়া হয়েছে বিস্তর। শেষমেশ অবশ্য সবকিছু উতরে গিয়েছে। শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের মধ্যে বাতাসে বিষাক্ত গ্রিন হাউস নিঃসরণ বৃদ্ধির মাত্রা একেবারে শূন্য করার অঙ্গীকার করেছেন ধনী-দরিদ্র মিলিয়ে ১৯৬টি দেশের রাষ্ট্রনেতারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী’ প্যারিস চুক্তি বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিল বিশ্ব অর্থনীতিকে। জীবাশ্ম জ্বালানি যুগের অবসান ঘটিয়ে দূষণ মুক্ত জ্বালানি যুগের সূচনার ইঙ্গিত দিচ্ছে এই চুক্তি। অথচ বিশ্ব অর্থনীতির অনেকটাই এখনও জীবাশ্ব জ্বালানির উপরেই নির্ভরশীল।
রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর। সাংবাদিকদের তিনি জানান, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে উন্নয়নের অধিকার দিল প্যারিস চুক্তি। দু’সপ্তাহের প্যারিস সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। বারাণসী থেকে টুইটারে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। লিখেছেন, ‘‘কারও হার বা জিত হয়নি। সুবিচার পেয়েছে জলবায়ু। সবুজ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে গেল আমাদের বিশ্ব।’’
জলবায়ু চুক্তি সফল করার পিছনে বিপুল কূটনৈতিক প্রয়াস ছিল ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদের। খসড়া যাতে কোনও ভাবেই বাতিল না হয়, তা নিশ্চিত করতে মার্কিন কংগ্রেসের অনুমোদনের কোনও সুযোগই রাখা হয়নি এতে। চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই উচ্ছ্বসিত তিনি। বলেছেন, ‘‘ইতিহাস তৈরির সুযোগ মেলে কম। আমরা সে রকমই মুহূর্তের সাক্ষী হলাম।’’
জয় রাষ্ট্রপুঞ্জেরও। চার বছর ধরে রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা এবং ধনী ও দরিদ্র দেশগুলির মধ্যে গভীর বিভাজন দূর করার চেষ্টা চালাচ্ছিল তারা। চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ প্রধান ক্রিস্টিয়ানা ফিগের টুইটারে লিখেছেন, ‘‘আগে বলতাম, আমাদের পারতেই হবে, আমরা পারি, আমরা পারব। আজ বলছি, আমি পারলাম।’’ খুশি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও। হোয়াইট হাউস থেকে বিবৃতিতে বিশ্বকে রক্ষা করার সেরা সুযোগ বলে চুক্তির প্রশংসা করেছেন তিনি। চুক্তি সাক্ষর হওয়ায় রাষ্ট্রপুঞ্জের উপর আস্থা ফিরে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ু কমিশনার মিগেল অ্যারিয়াস ক্যানেট। রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চে ছিলেন প্রাক্তন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর-ও। ১৯৯৭ সালের কিয়োটো প্রোটোকলের অন্যতম স্রষ্টা ছিলেন তিনি। চুক্তির খবরে আবেগবিহ্বল তিনি। সতর্কভাবে পরে শুধু বলেছেন, ‘‘বড়সড় প্রভাব পড়তে চলেছে অর্থনীতিতে।’’ চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল, রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান কি মুন-ও।
ছ’বছর আগে কার্যত ভেস্তে গিয়েছিল কোপেনহাগেন জলবায়ু বৈঠক। সফল হয়েছে প্যারিস। দু’সপ্তাহের আলোচনায় গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করার প্রতিজ্ঞা নিল ধনী, উন্নয়নশীল, দরিদ্র নির্বিশেষে ১৯৬টি দেশ। আইনি ভাবে চুক্তির সমস্ত শর্ত মানা বাধ্যতামূলক হলেও ছাড় রয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে।
চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরাও। তবে শর্তে বেশ কিছু ফাঁক থাকার বিষয় সতর্ক করেছেন তাঁরা। গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা কমানোর লক্ষ্যে কী কী পদক্ষেপ করা উচিত, সে বিষয়ে চুক্তিতে নির্দিষ্ট পথের উল্লেখ নেই বলে আক্ষেপও করেছেন।