বড় রকমের রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখে এখন নওয়াজ শরিফ।
পাকিস্তান সরকারের আশঙ্কা, পানামা-দুর্নীতির জেরে সুপ্রিম কোর্ট কিছু দিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত পর্যন্ত করতে পারে। আর সম্ভাব্য সেই নাটকীয় ঘটনার পিছনে আছে পাক সেনাবাহিনীর সক্রিয় মদত। পরিস্থিতি এতটাই ঘোরালো হয়ে উঠেছে যে, ভারতের কাছে পাক সরকার ‘ট্র্যাক-টু’ কূটনীতির মাধ্যমে জানিয়েছে, এই সঙ্কটের সময়ে নরেন্দ্র মোদী সরকার যাতে নওয়াজের পাশে থাকেন। সেনাবাহিনী-আইএসআই ও মৌলবাদীদের সঙ্গে নওয়াজের সম্পর্ক আবার দ্রুত খারাপ হতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় নওয়াজের অনুরোধ, ভারত দ্রুত বিদেশসচিব পর্যায়ের আলোচনা নতুন উদ্যমে শুরু করুক। পাকিস্তানের বক্তব্য, দু’পক্ষের আলোচনা শুরু হয়ে গেলে সেনাবাহিনীর প্রাসঙ্গিকতা কমে যায়। সচিব পর্যায়ে আলোচনা বন্ধ হলেই কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণরেখায় গোলাবর্ষণ বেড়ে যায়। এমনকী আলোচনার সম্ভাবনা দেখা দিলেই এই সন্ত্রাস সেনাবাহিনী বাড়িয়ে দেয়, কারণ আলোচনা শুরু হলে নির্বাচিত সরকারের গুরুত্ব ইসলামাবাদে বেড়ে যায়। ভারত অবশ্য এখনও এ ব্যাপারে হাতের তাস নওয়াজকে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেখায়নি। তবে আপাতত পাকিস্তান নিয়ে ধীরে চলার ইঙ্গিতই দিয়েছে দিল্লি। তারা জানিয়েছে, যদি সন্ত্রাস নিয়ে পাকিস্তান আরও কিছু সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেয়, তা হলে উত্তরপ্রদেশ ভোটের পরে আলোচনা শুরু হতে পারে।
পানামা পেপার ফাঁস হয়েছে ২০১৬ সালে। সেই দুর্নীতির তালিকায় পৃথিবীর একাধিক রাষ্ট্রনেতার মধ্যে নওয়াজ শরিফের নামও ছিল। এই রিপোর্ট থেকে জানা যায়, নওয়াজ কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ও দুর্নীতির নায়ক। তাঁর চার সন্তানের মধ্যে মেয়ে মারিয়াম, ছেলে হাসান ও হুসেন— এই তিন জন একাধিক বেসরকারি কোম্পানির মালিক। পানামার আইন ফার্ম মোসাক ফনসেকা (Mossack Fonseca)-র কাগজপত্র থেকে পৃথিবীর বহু রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে একাধিক অফসোর কোম্পানির যোগাযোগ (লিঙ্ক)-এর কথা বেরিয়ে আসে। আগের বার ক্ষমতায় থাকাকালীন নওয়াজ লাহৌর বাসযাত্রা করলেও তৎকালীন সেনাপ্রধান পারভেজ মুশারফ কারগিল যুদ্ধ বাধিয়ে দেন এবং নওয়াজকে বরখাস্ত করে ক্ষমতাসীন হন। এ বার তাই প্রথম থেকেই নওয়াজ খুব সচেতন ছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করেই এগোচ্ছিলেন। আইএসআই-প্রধান নিয়োগ, এমনকী ভারতের সঙ্গে ট্র্যাক-টু আলোচনার জন্য সেনার সঙ্গে কথা বলে প্রাক্তন সেনা অফিসার নাসির খান জানজুয়াকে মনোনীতও করেন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে নওয়াজের উপর যে ভাবে মার্কিন চাপ বাড়ছে, তাতে সেনাবাহিনী ক্ষিপ্ত। ট্রাম্পের সঙ্গে নওয়াজের ফোনে দীর্ঘ কথোপকথনের পর সেনা-ঘনিষ্ঠ লাহোরের আর এক নেতা তথা তেহরিক-ই-ইনসাফের প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খান প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘‘ট্রাম্প পানামা দুর্নীতির হাত থেকে নওয়াজকে বাঁচাতে পারবেন না।’’
ইসলামাবাদের সুপ্রিম কোর্টে নওয়াজের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগকারী ইমরান। তিনি একা নন। ইমরানের সঙ্গে অভিযোগকারী হিসেবে আছেন আরও ছ’জন। গত ৫ এপ্রিল নওয়াজ জাতির উদ্দেশে বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘‘আমার ও আমার পরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে।’’ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আনওয়ার জাহির জামার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি টিম নওয়াজের বিরুদ্ধে টানা শুনানি শুরু করেছে। নওয়াজের মেয়ে ও ছেলেকে আদালতে শুনানির জন্য যেতে হচ্ছে।
নওয়াজের আইনজীবী সংবিধানের বিভিন্ন ধারা উল্লেখ করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যিনি সাংবিধানিক রক্ষাকবচ পেয়েছেন, তাঁকে এ ভাবে সরানো সম্ভব নয়। ইমরান ও সেনাবাহিনী এই যুক্তি মানছে না। সেনাপ্রধান নওয়াজের নাম না করেই বলেছেন, ‘‘সন্ত্রাস দমন সম্ভব, যদি উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি দমন সম্ভব হয়।’’ এর আগে, কারগিল যুদ্ধের পর নওয়াজকে বরখাস্ত করার সময়ও দুর্নীতি একটা বড় ইস্যু হয়েছিল। এ বারও সুপ্রিম কোর্ট নওয়াজের বিরুদ্ধে কমিশন গঠন করতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান এবং মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির অন্য সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন মোদী। আলোচনা শুরু করা নিয়ে পাকিস্তানের প্রস্তাবে আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারত সাড়া দেয়নি। তবে এ কথা ঠিক, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে সামরিক শাসন চালু হোক, ভারত চায় না। কিন্তু প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে নাক গলাতেও রাজি নন মোদী।
অজিত ডোভালের সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি অভিমত আছে। তা হল, পাকিস্তানে নওয়াজের চেয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি কথাবার্তা বলে একটা বোঝাপড়ায় পৌঁছনোই কি সঠিক পদক্ষেপ নয়? পাক রাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রক সেনাবাহিনী। তাই তার সঙ্গে কথা বলাই তো ভাল। বরং দু’টি পৃথক প্রতিষ্ঠান সমান্তরাল ভাবে থাকলে সমস্যা বাড়বে। আমেরিকার চাপে এ বার হাফিজ সইদকে গৃহবন্দি করা হলেও নওয়াজ সেটি নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথা বলে জল মেপেই এগিয়েছেন।
ভারত অবশ্য প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীর সমর্থনে এখনই এগিয়ে আসছে না। আবার বিদেশ মন্ত্রক সূত্র এ-ও বলছে, পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত যদি দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়, এমনকী কমিশন গঠন করে নওয়াজকে বরখাস্ত পর্যন্ত করে, তা হলে ভারত কখনওই দুর্নীতির পক্ষে বক্তব্য রেখে নওয়াজের পাশে থাকতে পারে না।
আপাতত তাই কৌশলী নীরবতার পথেই হাঁটবে ভারত।