এই সেতু কে ঘিরেই আশাবাদী শেখ হাসিনা।
‘স্বপ্নের সেতু।’
বাংলাদেশের সর্বত্র পদ্মা সেতুর সঙ্গে এ ভাবেই জাতীয় আবেগকে মিশিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথা আওয়ামি লিগ সরকার। এক সপ্তাহ পরেই যার সাড়ম্বর উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
দশ বছর আগে, বিশ্ব ব্যাঙ্ক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে হাত তুলে নেওয়ার পরে একে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন হাসিনা। দেশের প্রতিটি মানুষের স্বপ্নের সঙ্গে তাকে যুক্ত করে সাধারণ মানুষের ন্যূনতম চাঁদা নিয়ে বিষয়টিকে এক পরিকাঠামো-আন্দোলনের চেহারা দিয়েছিলেন। আগামী ২৫ জুন তার উদ্বোধনের আগে ঢাকার রাজনৈতিক মহল বলছে, ২০২৩-এ হতে চলা বাংলাদেশের নির্বাচনে পদ্মা সেতুকে বিকাশের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সুফলকে ছড়িয়ে দেওয়ার বার্তা, আওয়ামি লিগের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠতে চলেছে।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বিশ্ব ব্যাঙ্কের কর্তা, বা সেই সময় সেতু-দুর্নীতির অভিযোগে সরব বিএনপি-নেত্রী খালেদা জিয়া অথবা নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে ২৫ তারিখ নিমন্ত্রণ করে মধুর শোধ নিয়েছেন হাসিনা। তাঁরা আসবেন কিনা সে প্রশ্ন ভিন্ন। কিন্তু হাসিনা নিজেকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ২৫ তারিখই প্রতিষ্ঠা করার কাজটি শুরু করে দেবেন।
কূটনৈতিক শিবির বলছে, এই মুহূর্তে অঞ্চলের ভূকৌশলগত পরিস্থিতি সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন হাসিনা। চিন-নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠার বার্তা দিচ্ছেন বার বার, কিন্তু বিনিয়োগের প্রশ্নে কাউকেই অচ্ছুৎ রাখছেন না। সরকারের এক কর্তার কথায়, “পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী কাউকেই ব্রাত্য বলে মনে করেন না। আবার একই সঙ্গে তিনি ভারসাম্য রেখে চলার পক্ষপাতী।” ২০১৫ সালে ভারতকে ছাপিয়ে চিন হয়ে ওঠে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ২০১৬ সালের বাংলাদেশ সফরে ১৩.৬ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই হয় দু’দেশের মধ্যে। এর পরে ২০১৯ সালে বেজিং সফরের পরে হাসিনা ঘোষণা করেন, চিন চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। চিনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা (সাবমেরিন) ক্ষেত্রেও বোঝাপড়া হয় ঢাকার।
কূটনৈতিক সূত্রের মতে, চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের বাড়বাড়ন্ত সত্ত্বেও চিনের দিকে ঢলে যায়নি হাসিনা সরকার। ভারতের সঙ্গে নিজেদের ‘রক্তের সম্পর্কের’ কথা তাই বার বার উল্লেখ করতে শোনা যাচ্ছে সরকারের কর্তাদের মুখে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যাতে পণ্য পরিবহন সহজ এবং দ্রুত হয়, সে জন্য ভারতকেও চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর ব্যবহার করার প্রস্তাব দিয়েছে ঢাকা। এ জন্য পরিকাঠামো সংযোগের কাজ বাংলাদেশের দিক থেকে কিছু বাকি রয়েছে। সে দেশের তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদের কথায়, “আমরা এই বছরের শেষে বা আগামী বছরের গোড়াতেই কাজ শেষ করে ফেলব। ভারতের উত্তর-পূর্বে সফর করে দেখেছি সেখানকার মানুষের কতটা আগ্রহ রয়েছে এই প্রকল্পে।”
শ্রীলঙ্কার বিপর্যয়ের পর চিনা সহযোগিতা নিয়ে আরও কিছুটা সতর্ক হতে দেখা যাচ্ছে ঢাকাকে। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাই স্পিড রেলওয়ে নির্মাণের জন্য টানা দৌত্য করে চলেছে বেজিং। কিন্তু ওই প্রকল্প থেকে পিছিয়ে এসেছে হাসিনা সরকার। কোনও বাড়তি খরচ বা ঋণ নেওয়ার আগে তা খতিয়ে দেখার প্রবণতা বেড়েছে। পাশাপাশি কোনও একটি দেশের উপর নির্ভরতাও তৈরি করতে চাইছে না আজকের বাংলাদেশ, তা স্পষ্ট। একই সঙ্গে চিনা সংস্থা নির্মাণ করেছে পদ্মা সেতু, গোটা ঢাকা জুড়ে মেট্রো রেলের কাজে শামিল হয়েছে জাপানের সংস্থা, রাশিয়া রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক শক্তি প্রকল্পে, সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পে ভারতের এনটিপিসি কাজ করছে বাংলাদেশের সঙ্গে।
১৯৭১-এ আমেরিকার বিদেশ সচিব হেনরি কিসিঙ্গার ব্যঙ্গ করে বাংলাদেশকে ‘তলা-বিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন। তার পঞ্চাশ বছর পরে পরিকাঠামো প্রযুক্তির এক বিস্ময় পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ঠিক আগে গর্বের সঙ্গে সে দেশের তথ্যমন্ত্রী ভারতীয় সাংবাদিকদের বলছেন, “ঢাকার রাস্তায় একটিও ভিক্ষুক আজ দেখতে পাবেন না।”
এই নতুন বাংলাদেশের মোড়কই আগামী পঁচিশে বিশ্ববাসীর সামনে খুলবেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।