জাপানের নাগাসাকিতে ৭০ বছর আগে পড়া পরমাণু বোমার তাণ্ডবলীলা।
বছরের শুরুতেই বোমাটা ফাটালো উত্তর কোরিয়া!
নতুন বছরে কোনও চমক অপেক্ষা করে আছে, ডিসেম্বরের শেষে এক বার আভাস দিয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং উন। ‘‘হাইড্রোজেন বমার বিকট আওয়াজেই বর্ষবরণ করব’’— গত মাসের ১৫ তারিখ এক নির্দেশে সই করে লিখেছিলেন এ কথা। শাসকের সেই স্বপ্ন আজ সত্যি করে তুললেন সে দেশের বিজ্ঞানীরা।
বুধবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টা নাগাদ প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে ওঠে দেশের উত্তর-পূর্ব উপকূলের পুঙ্গাই-রি। এর ঠিক সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পরে প্রথম খবর ভেসে ওঠে সরকারি টিভি চ্যানেলে। খবর পড়ছিলেন যিনি, তিনি জানান— দেশে প্রথম হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ সফল হয়েছে। তবে এটা যে কম শক্তিশালী, হাইড্রোজেন বোমার ছোট সংস্করণ, সেটাও উল্লেখ করতে ভোলেননি তিনি। এই একটা সাফল্য তাদের অস্ত্রাগারকে আরও কত গুণ শক্তিশালী করে তুলল, আজ সে কথাও সারা দিন ধরে বারে বারে প্রচার করা হয়েছে সরকারি টিভিতে। এ দিকে পরীক্ষা সফল হওয়ার কথা শোনামাত্র উৎসব শুরু হয়ে যায় পিয়ংইয়ং স্টেশনের বাইরে। ‘সুখবর’ দেওয়ার জন্য আজ সেখানে টাঙানো হয়েছিল বিশাল টিভি স্ক্রিন। আনন্দে সেই টিভির খবরের ভিডিওই মোবাইল-বন্দি করতে শুরু করেন অনেকে।
খুশির রেশ অবশ্য দেশের মাটিতেই সীমাবদ্ধ। উত্তর কোরিয়ার বাইরের ছবিটা আসলে একেবারেই উল্টো। নতুন করে পরমাণু অস্ত্রের চোখরাঙানি ভয় ধরিয়েছে বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও। কারণ, ‘লিটল বয়’ বা ‘ফ্যাট ম্যান’ নয় (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে দু’টি পরমাণু বোমায় ধ্বংস হয়েছিল হিরোশিমা ও নাগাসাকি), যে হাইড্রোজেন বোমার কথা উত্তর কোরিয়া বলছে, তার শক্তি আগের অস্ত্রের চেয়ে অনেক, অনেক গুণ বেশি। আর এটাই ভাবাচ্ছে সকলকে। তাই উত্তর কোরিয়ার পরীক্ষার খবর পেয়ে তড়িঘড়ি নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডেকেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, আমেরিকা থেকে কিমের বন্ধু-রাষ্ট্র চিনও একযোগে নিন্দা করেছে আজকের এই ঘটনার। শক্তির আস্ফালন যাতে প্রকট না হয়, এক দিকে কূটনৈতিক স্তরে সেই চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠছে, উত্তর কোরিয়ার দাবি কি আদৌ পুরোপুরি ঠিক?
এমনিতে এই দ্বীপরাষ্ট্রের খবর বাইরের দুনিয়ায় খুব একটা আসে না। কিম জং উনের রাজত্বে সরকার যেটুকু জানাতে চায়, বাকি পৃথিবী জানে শুধু সেটাই। তবে এ বার অবশ্য হিসেব গরমিল হচ্ছে বহু জায়গাতেই। বিশেষজ্ঞদের দাবি, পরমাণু বোমা আর হাইড্রোজেন বোমার মধ্যে তফাত রয়েছে অনেক। পরমাণু বোমায় পরমাণুর নিউক্লিয়াস নিউট্রন ও গামা ফোটনে ভেঙে যায়। একে ‘ফিশন’ বলে। আর হাইড্রোজেন বা ‘সুপার বম্ব’-এ যা হয়, সেটা আসলে ‘চেন রিঅ্যাকশন।’ প্রথমে পরমাণু বোমার মতোই ফিশন পক্রিয়ায় পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে প্রচুর শক্তি নির্গত হয়। এর পর এই শক্তির জন্যই হাইড্রোজেনের দুই বা তার বেশি নিউক্লিয়াস একে অপরের দিকে ছুটে এসে প্রচণ্ড গতিতে ধাক্কা মারে। এরা জুড়ে গিয়ে জন্ম নেয় নতুন নিউক্লিয়াস। আর তাতেই তৈরি হয় বিপুল শক্তি। এই দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটিকে বলে ‘ফিউশন।’ বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, ফিউশনের জন্যই পরমাণু বোমার থেকে হাইড্রোজেন বোমার অভিঘাত প্রায় হাজার গুণ বেড়ে যায়।
এই সংক্রান্ত আরও খবর...
পরমাণু বোমার কাছে হাইড্রোজেন বোমা ‘দানব’!
সঙ্কট আরও জটিল হল উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক পরীক্ষায়
আণবিক দানবিক
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী পরমাণু বোমা
সন্দেহটা তাই উড়িয়ে দিতে পারছেন না অনেকেই। আজ হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণের খবর জানার পর মার্কিন ভূ-তাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ জানায়, উত্তর কোরিয়ার আশপাশে ৫.১ মাত্রার ভূমিকম্প ধরা পড়েছে সিসমোগ্রাফ যন্ত্রে। বিস্ফোরণে যে শক্তি নির্গত হয়েছে তার পরিমাণ ৬ কিলোটনের কাছাকাছি। বিপুল শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা ফাটলে এই সংখ্যাগুলো কিন্তু এত কম হওয়ার কথা নয়। এর আগে ২০০৬, ২০০৯ ও ২০১৩ সালে তিন বার পরীক্ষামূলক ভাবে পরমাণু বোমা ফাটিয়েছে কিমের দেশ। শেষ পরীক্ষাতেই শক্তির পরিমাণ ছিল ৬-৭ কিলোটন। সেই নিরিখে এ বার তাদের উন্নততর অস্ত্র নিজেদের আগের হিসেবকেই টপকাতে পারেনি। বিজ্ঞানীদের অনেকে এ-ও বলছেন, হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ যদি সফল না হয়, সে ক্ষেত্রেও ১০ কিলোটন শক্তি তৈরি হওয়ার কথা। তাই উত্তর কোরিয়ার আজকের দাবি নিয়ে ঘোরতর প্রশ্ন রয়েছে তাঁদের।
তা ছাড়া, চিন পরে জানিয়েছে— বাতাসে বিকিরণের মাত্রায় তারা আজ অস্বাভাবিক কিছু পায়নি। জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকও বিকিরণ পরীক্ষা করার জন্য তিনটি বিশেষ বিমানকে কাজে লাগিয়েছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু যে পাওয়া যায়নি, প্রকারান্তরে তা মেনে নিয়েছেন জাপানের ক্যাবিনেট সচিব।
এ সব দেখেই দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা ফোরামের সদস্য ইয়াং উক-এর পর্যবেক্ষণ, যে প্রমাণ এখনও মিলেছে, তাতে মনে হয় পরমাণু ও হাইড্রোজেন বোমার মাঝামাঝি কিছু একটা ফাটিয়েছে উত্তর কোরিয়া। পরমাণু বিশেষ়জ্ঞ জো সিরিনসিওনের আবার দাবি, সাধারণ পরমাণু বোমার মধ্যেই হয়তো হাইড্রোজেন আইসোটোপ ব্যবহার করেছে কিম জংয়ের দেশ। আর সে কারণেই একে হাইড্রোজেন বোমা বলে প্রচার করছে তারা।
আজকের বিস্ফোরণ আসলে কী, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও বড় শক্তিগুলি আবার ভয় পাচ্ছে অন্য কারণে। হাইড্রোজেন বোমা পারমাণু বোমার থেকে আকারে অনেক ছোট। ক্ষেপণাস্ত্রে পুরে উত্তর কোরিয়া থেকে তা আমেরিকার মাটিতে ছোড়াও হয়তো অসম্ভব হবে না এক দিন। কিমের দেশের বিজ্ঞানীরা এখনই তার নাগাল না পেলেও যে ভাবে এগোচ্ছেন তাতে হয়তো ভবিষ্যতে রাজার সেই সাধও পূরণ করে দেবেন তাঁরা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ইরানকে আলোচনার টেবিলে ডেকে চুক্তিতে বাঁধতে পারলেও উত্তর কোরিয়া সেই রাস্তায় হাঁটেইনি। এ বার রাষ্ট্রপুঞ্জও উদ্যোগী হয়েছে। তবে রাজনৈতিক মহলের ধারণা, নিরাপত্তা পরিষদ নয়, এ বার কাজ হাসিল হতে পারে শুধু চিনের দৌলতে। উত্তর কোরিয়ার এই বন্ধুও আজ তাদের পরীক্ষাকে খোলা গলায় নিন্দে করেছে। চিনের মতো দেশের সাহায্য বন্ধ হয়ে গেলে রীতিমতো চাপে পড়ে যাবে উত্তর কোরিয়া। তাই হয়তো এখনই চিনকে চটাতে চাইবে না তারা। আর চিনও যুদ্ধ বাধিয়ে প্রতিবেশী দেশে মার্কিন সেনা দেখতে চায় না। সেখানে শান্তি বজায় রাখতে চিনের মধ্যস্থতায় উত্তর কোরিয়া ক্ষমতা প্রদর্শনে রাশ টানে কিনা, এখন সেটাই দেখার।
এ সব কূটনীতি নিয়ে না হয় কিছু দিন মাথা ঘামান বাকি রাষ্ট্রনেতারা। আর দু’দিন বাদেই কিম জং উনের নাকি জন্মদিন। তায় আবার মে মাসে ৩৫ বছর বাদে বসছে শাসক দল ‘কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টি’র কংগ্রেস। এত কিছুর মাঝে বোমা ফাটিয়ে আপাতত সাফল্যই তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করতে চান একনায়ক কিম। তাঁর খেয়াল যে এমন উদ্ভট, সে কি আর এত দিন বাদেও বলার অপেক্ষা রাখে!