সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নিহতের দেহ।
সদ্য ছুটি হয়েছে স্কুল। কচিকাঁচাদের হুল্লোড়ে রাস্তায় তখন কান পাতা দায়। তার মধ্যে আবার হ্যালোইন! বাচ্চাকে স্কুল থেকে নিতে এসেছিলেন লিন। ‘‘হঠাৎই বিকট আওয়াজ। একটা ট্রাক এসে ধাক্কা মারল স্কুলবাসে। ভাগ্য ভাল, বড় কোনও ক্ষতি হয়নি। বাসে বেশি কেউ ছিল না। ভেবেছিলাম নিছকই দুর্ঘটনা। কিন্তু তার পর যা দেখলাম, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার জোগাড়,’’ বললেন তরুণী।
৯/১১-এর সেই জায়গাটার থেকে মাত্র কয়েকটা ব্লক দূরে ঘটনাস্থল। রোদ ঝলমলে হ্যালোইন। চেনা চেহারাতেই ছিল ম্যানহাটন। হঠাৎই সুর কাটল সাইরেনের আওয়াজে। চার পাশে পুলিশ থিকথিক, মানুষের আর্তনাদ, রক্ত, ছিন্নভিন্ন দেহ!
লিন জানালেন, ওয়েস্ট স্ট্রিটে এসে ট্রাক থেকে নেমে পড়ে চালক। মাঝরাস্তায় পাগলের মতো ছুটতে শুরু করে। হাতে দু-দু’খানা বন্দুক। কিছু ক্ষণের মধ্যেই চলে আসে পুলিশ। পর পর চারটে গুলি, লুটিয়ে পড়ে লোকটি। লিনের মতোই অন্য মা-বাবারাও তত ক্ষণে বুঝে গিয়েছেন, নিউ ইয়র্কে ফের জঙ্গি-হানা। বাচ্চাদের আঁকড়ে ধরে একটু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে শুরু করেন তাঁরা। বছর ছত্রিশের টম কেনড্রিক আবার চেম্বারস স্ট্রিট ধরে জগিংয়ে বেরিয়েছিলেন। দেখে শিউরে ওঠেন, রাস্তার উপরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে থেঁতলে যাওয়া দেহ, ভাঙাচোরা সাইকেল। ‘‘আমি ছুটে গিয়েছিলাম সাহায্য করতে...। না, প্রাণহীন দেহগুলোর আর সাহায্যের দরকার ছিল না।’’
কাছেই স্ট্যুভেস্যান্ট স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে জেরেমি মুলার, ওমর কাসত্রাত এবং লিও শেসটাকভ। ছুটি হয়ে গিয়েছিল তাদেরও। শেসটাকভ বলে, ‘‘স্কুল থেকে বেরিয়ে সামনের পার্কটায় ঢুকেছিলাম তিন জনে। হঠাৎ দেখি লোকজন ছুটে আসছে আমাদের দিকে। চিৎকার করছে, ‘ধাক্কা মেরেছে...’।’’ এ দু’টো শব্দের কী যে অর্থ, উদ্ধার করতে পারেনি তিন পড়ুয়া। কিন্তু ভয়ঙ্কর কিছু যে ঘটেছে, সেটা বেশ বুঝেছিল তারা। মুলার বলে, ‘‘আমি
আবার এগিয়ে দেখতে যাই কী হয়েছে। দেখি, একটা লোক ওয়েস্ট স্ট্রিটের মাঝখানে পাগলের মতো এ দিক-ও দিক ছুটছে। তখনও ধারেকাছে কোনও পুলিশ নেই। বুঝতে পারিনি যে জঙ্গি হামলা।’’ ১৩ বছরের এক কিশোরী আবার একেবারে জঙ্গির সামনাসামনি পড়ে গিয়েছিল। ঘটনার পর থেকে কারও সঙ্গে কথা বলছে না সে।
হামলার ঘণ্টাখানেক পরেও দেখা গেল ওয়ারেন স্ট্রিটের প্রাথমিক স্কুলের বাইরে উদ্বিগ্ন মা-বাবাদের জটলা। নীল রঙা পোশাকে পুলিশ আপ্রাণ চেষ্টা করছে ভিড় সামলানোর। —‘‘একটু ধৈর্য ধরুন, বাচ্চারা আসছে।’’ স্কুলের দরজা খুলে দিতে অবশ্য দেখা গেল খুদেরা দিব্য চিপস, লজেন্স খেতে-খেতে বের হচ্ছে। অনেকেই হ্যালোইনের সাজে। কেউ ব্যাটম্যানের পোশাকে তো কেউ রাজকুমারী সেজে। খুদেদের কাউকেই বাইরের খবর জানানো হয়নি।
স্ট্যুভেস্যান্ট স্কুলের ইংরেজির শিক্ষিকা অ্যানি টমাস অবশ্য বললেন, তিনি তাঁর ক্লাসের পড়ুয়াদের জানিয়ে দিয়েছিলেন জঙ্গি হানার খবর। নিজেই বলেছিলেন, ফোন করে বাড়িতে খবর দিতে যে, তারা ঠিক আছে। স্কুলের ভিতরে মাইকে ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল, কোনও পড়ুয়াকে যাতে বাইরে বেরোতে দেওয়া না হয়। ২৮ জন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে টানা তিন ঘণ্টা ক্লাসে বসেছিলেন অ্যানি। পড়াশোনা অবশ্য তেমন কিছু হয়নি। কিছু ক্ষণ রসায়ন পড়ানো হয়েছে, তার পর কেউ গান শুনিয়েছে, অনেকে অন-লাইনে গেম খেলেছে, গল্প-আড্ডায় প্রায় জোর করে কাটানো হয়েছে সময়টা।
অ্যানির আক্ষেপ, ‘‘আমাদের স্কুলের অনেক পড়ুয়াই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। খারাপ লাগে, এই সব ঘটনার জেরে ওদের শিশু-মনে প্রভাব পড়ে। ওরা তো নিষ্পাপ!’’
এ দিনের হামলায় নিহত হয়েছেন আর্জেন্তিনার পাঁচ জন নাগরিক। পাঁচ বন্ধু মিলে নিউ ইয়র্কে এসেছিলেন স্নাতক হওয়ার ৩০ বছরের পুনর্মিলনে যোগ দিতে। রোজারিও-র পলিটেকনিক স্কুল থেকে স্নাতক হয়েছিলেন। সবারই বয়স তাই ৫০-এর আশপাশে। এঁদের সঙ্গে আরও এক জন আর্জেন্তিনীয় ছিলেন। তবে তিনি জখম, আপাতত বিপন্মুক্ত। প্রাণ হারিয়েছেন বেলজিয়ামের এক নাগরিকও। নিহত বাকি দু’জনের পরিচয় জানা যায়নি।