নববর্ষের মেনুতে এ বছর খোদ শেখ হাসিনার পড়ল না ইলিশমাছ!
মার্চ এবং এপ্রিলের এই সয়য়টায় ইলিশ ধরায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশে। তাই প্রধানমন্ত্রী হাসিনা নিজেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে দুপুরে বেছে নিলেন ভুনি খিচুড়ি আর ডিমের ডালনাকে।
কিন্তু নববর্ষের ভোরে রমরম করে গোটা ঢাকা জুড়ে মাটির সানকিতে বিক্রি হচ্ছে পান্তা-ইলিশ ভাজা। বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার দেশবাসী কাকভোর থেকেই মজেছেন ইলিশ মাছে। গত কয়েক দশক ধরেই এই ‘পহেলা বৈশাখ’-র প্রাতরাশে যেন সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে উঠেছে এই পান্তা-ইলিশ।
তবে শুধু রসনাই আজকের একমাত্র থিম নয়। দাঁড়িয়ে আছি ঢাকার রমনা বটবৃক্ষের তলায়, যা এ দেশে তোলপাড় করা আবেগের গ্রাউন্ড জিরোও বটে। সেখানে ভোরবেলা থেকেই দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথ। যেখানে মাথায় রঙবেরঙের ফুল, লাল পাড় ঢাকাইয়ে রূপোসী বাংলা। যেখানে দুর্দান্ত গরম আর ঘাম উপেক্ষা করে হাত পাখা হাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ। ঢাকা আজ নেমে এসেছে রাজপথে।
আরও দেখুন-বাংলাদেশে বাংলার বর্ষবরণ
আর আসবে না-ই বা কেন? ঘোষিত ভাবেই আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উত্সব। ব্যপ্তিতে, ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রশ্নে, জাতির আবেগের সলতে জ্বালানোয়, এমনকী সাংস্কৃতিক প্রতিবাদেও এটি সর্বাধিক সমাদৃত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঢের আগে সেই ’৬৪ সালে তৎকালীন পাক সরকার রবীন্দ্রনাথের গান বেতারে পরিবেশনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। যা মন থেকে মেনে নেননি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। ৫০ জন, ১০০ জন, ২০০ জন করতে করতে এই রসনা পার্কে বটগাছের তলায় নববর্ষের সকালে খালি গলায় রবীন্দ্র সঙ্গীতের আয়োজন করতেন মানুষ, এ দেশের সবচেয়ে বড় সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের নেতৃত্বে, আজ দেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছর পরেও সেই ছায়ানটই থেকে গেছে সেই পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানের প্রধান পুরোধা হয়ে। সোহরবার্গী উদ্যান, শিশু পার্ক-সহ ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় খোলা আকাশের নীচে অনুষ্ঠান হয় ঠিকই, কিন্তু এক অলিখিত নিয়মে ভোর পাঁচটায় প্রথম অনুষ্ঠান শুরু হয় রমনা বটবৃক্ষের তলায়, ‘এসো হে বৈশাখ’ গানের হাত ধরে।
আসলে এই রমনা বটবৃক্ষ নিয়ে আবেগের শিকড়টা অনেক গভীরে প্রেথিত। ভাষা আন্দোলনের ব্যাকগ্রাউন্ডটা কিন্তু এই গাছের তলাতেই তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জাতিসত্ত্বার আঁতুড়ঘর কিন্তু এটাই। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সেই সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের রেশ আজও একই রকম প্রাসঙ্গিক। ২০০১ সালে এখানে বৈশাখী অনুষ্ঠান চলাকালীন বোমা বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়ে ছিলেন বহু মানুষ। তারপর কেটে গেছে ১৫টা বছর। আজও কিন্তু হিংসা বাংলাদেশের নিত্তনৈমিত্তিক বাস্তব। পয়লা উৎসবের আড়ালে সে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার বিশ্বাসটা আজও প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেয়। তাই এই উৎসবে আঘাত হানতে পারলে সেই নিঃশ্বাস নেওয়ার রাস্তাটাই যে অবরুদ্ধ হয়ে যাবে, সেই সহজ সত্যিটা যারা হিংসা ছড়ায় তাদের ভালই জানা। সেই কারণেই জামাতের হিংসা, ব্লগার হত্যা, বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর চোরাগোপ্তা হামলার নিশানায় এখনও আতঙ্কিত এই উত্সব। তাই কূল ছাপানো আবেগকে নিরাপত্তা দিতে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সক্রিয় সরকার। অসংখ্য সিসিটিভি, সাদা পোশাক এবং উর্দিধারী হাজার হাজার পুলিশ নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় ঘিরে রেখেছে ঢাকার রাজপথ। বিকেল ৫টার পর খোলা আকাশের নীচে কোনও অনুষ্ঠানে জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা, প্রত্যেক বারের রীতি ভেঙে এ বারে নিষিদ্ধ মুখোশও।
কিন্তু আবেগ কী আর নিরাপত্তার ঘেরাটোপের হিসেব মানে, না কি মনে রাখে হিংসার রক্তচক্ষুর আস্ফালনকে? সেই আবেগেই ভাসমান হয়ে সবার দিকে ফুল এগিয়ে দেন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মীরা। নিজের অজান্তেই স্বৈরতন্ত্র বিরোধী, বিচ্ছিন্নতাবাদ বিরোধী, জাতীয়বাদের ভালবাসায় মোড়া সমবেত গানে গলা মেলান। ভবিষ্যতে বন্দুক নয়, গোলাপের তোড়া হাতে কুচকাওয়াজের ঘোর বাস্তব ঘেড়া স্বপ্নের বীজটা কি এভাবেই বেঁচে থাকে আবেগের আদরে? হয়ত। সেই স্বপ্নের পরশটাই আজ বোধহয় আরও একবার ছড়িয়ে দিল ঢাকার সকাল। বছর পয়লার দিনে।