National News

নাশকতার ভয়ঙ্কর গাড়ি! একই ছকে বার বার ঘায়েল হচ্ছে ইউরোপ

সাম্প্রতিক অতীতে ইউরোপে হওয়া অধিকাংশ সন্ত্রাসবাদী হামলাই এই কায়দায়। ট্রাক বা গাড়ি নিয়ে জনবহুল রাস্তায় হানা, তার পর ভিড়কে পিষে দেওয়ার চেষ্টা। ভয়ঙ্করতম নিদর্শন অবশ্যই দেখা গিয়েছে ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী ফরাসি শহর নিসে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৭ ১৮:০৪
Share:

জঙ্গি হামলায় আক্রান্ত হওয়ার পর লন্ডনের জনশূন্য রাস্তা, পরিত্যক্ত গাড়ি। ছবি: এএফপি।

মাস দেড়েক আগেই সুইডেনের এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গভীর আক্ষেপ নিয়ে টুইট করেছিলেন। লিখেছিলেন, ‘‘একটা লরি বা একটা গাড়ি চুরি করুন, তার পরে সেটা নিয়ে সোজা ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ুন। এটাই মনে হচ্ছে সন্ত্রাসের আধুনিকতম উপায়।’’

Advertisement

৭ এপ্রিল, ২০১৭। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়। শনিবার অর্থাৎ ৩ জুন, ২০১৭ ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনে যে কায়দায় হামলা হল, প্রায় সেই কায়দাতেই হামলা হয়েছিল স্টকহোমেও। ট্রাক নিয়ে ব্যস্ত শপিং স্ট্রিটে উন্মত্তের মতো ঢুকে পড়েছিল সন্ত্রাসবাদী। কাউকে পিষে দিয়ে, কাউকে ছিটকে দিয়ে, কাউকে ধাক্কা দিয়ে সেই জঙ্গি ট্রাক ভিড়িয়ে দিয়েছিল একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। মৃত্যু হয়েছিল চার জনের। জখম হন ১৫ জন। সুইডেনের পুলিশ জানিয়েছিল, হামলাকারীর নাম রাখমত আকিলভ। বছর চল্লিশের আকিলভ উজবেকিস্তান থেকে সুইডেনে গিয়েছিল। আইএস বা আল কায়েদা বা অন্য কোনও জঙ্গি সংগঠন তাকে হামলা চালানোর নির্দেশ দেয়নি। আকিলভ নিজে থেকেই সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির ভক্ত হয়ে উঠেছিল। তার পর হঠাৎ এক দিন ট্রাক নিয়ে ভিড়ের মধ্যে হামলা চালানোর ছক কষে ফেলেছিল।

সে দিনের ট্রাক-হামলার পর বিধ্বস্ত স্টকহোম। —ফাইল চিত্র।

Advertisement

সাম্প্রতিক অতীতে ইউরোপে হওয়া অধিকাংশ সন্ত্রাসবাদী হামলাই এই কায়দায়। ট্রাক বা গাড়ি নিয়ে জনবহুল রাস্তায় হানা, তার পর ভিড়কে পিষে দেওয়ার চেষ্টা। ভয়ঙ্করতম নিদর্শন অবশ্যই দেখা গিয়েছে ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী ফরাসি শহর নিসে। বাস্তিল দিবস উপলক্ষে উৎসবমুখর ফরাসি জনতার বিপুল সমাগম হয়েছিল প্রমনাদ দে আঁগলে-তে। উন্মত্ত ট্রাক নিয়ে সেই ভিড়ে ঠাসা রাস্তায় ঢুকে পড়েছিল হামলাকারী। ৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০০-রও বেশি মানুষ জখম হয়েছিলেন। আইএস এই হামলার দায় নিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ফরাসি গোয়েন্দারা জানিয়েছিলেন, নিস হামলা ছিল ‘লোন উলফ অ্যাটাক’। হামলাকারী মহম্মদ লহৌয়েজ বুহলেল-এর সঙ্গে আইএস-এর সরাসরি কোনও যোগ ছিল না। সে নিজে থেকেই আইএস-এর প্রতি সহানভূতিশীল হয়ে উঠেছিল। নিজেই নিজেকে কট্টরবাদে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তার পর বাস্তিল দিবসে নিজের উদ্যোগেই সন্ত্রাসবাদী হামলা চালিয়েছিল। জানিয়েছিলেন ফরাসি গোয়েন্দারা।

নিসের ভয়ঙ্কর হামলার স্মৃতিতে আজও শিউরে ওঠে গোটা ফ্রান্স। —ফাইল চিত্র।

জার্মানির রাজধানী বার্লিনেও হামলা একই কায়দায়। ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৬। ভিড়ে ঠাসা ক্রিসমাস মার্কেটে ট্রাক্টর-ট্রেলার নিয়ে হানা দেয় আনিস আমরি নামে এক যুবক। ১২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ৪৮ জন জখম। পরে ইতালিতে পুলিশের সঙ্গে এক শুট আউটে তার মৃত্যু হয়। এক ভিডিওয় সে দাবি করেছিল, সে আইএস-এর সঙ্গে যুক্ত। আইএস-ও দাবি করেছিল, আনিস আমরি তাদেরই সৈনিক। কিন্তু তদন্তের রিপোর্ট খতিয়ে দেখে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, আনিসের সঙ্গেও আইএস-এর কোনও সরাসরি যোগ ছিল না। সে-ও এক স্বঘোষিত আইএস জঙ্গিই ছিল।

এর পর ২২ মার্চ, ২০১৭-এ লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজে গাড়ি নিয়ে হামলা। ৩ জুন ফের লন্ডন। এ বার সন্ত্রাসের নিশানা লন্ডন ব্রিজ। আগের হামলায় মৃত্যু হয়েছিল ৫ জনের। এ বার ইতিমধ্যেই মৃতের সংখ্যা ৭-এ পৌঁছেছে। জখম অন্তত ৪৮।

গত কয়েক বছরে ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, স্পেন-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে হামলার সংখ্যা যে এই ক’টিতেই সীমাবদ্ধ, তা নয়। কিন্তু গত এক বছরের মধ্যে অধিকাংশ হামলাই যে ট্রাক বা গাড়ির হামলা, তা সাদা চোখেই দেখা যাচ্ছে। প্রায় সব ক’টি ক্ষেত্রেই হামলাকারীরা নিজেরাই নিজেদের নাশকতায় নামতে উদ্বুদ্ধ করেছে, একের পর এক তদন্ত রিপোর্টে তাও স্পষ্ট হচ্ছে।

শনিবার রাতে লন্ডন ব্রিজে সন্ত্রাসবাদী হানার পর পুলিশের গাড়ি দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছিল ব্রিজে ওঠার পথ। শহরের বিভিন্ন এলাকায় রাস্তায় এ ভাবেই গতিরোধ তৈরি করা হয়েছিল। আরও কোনও উন্মত্ত গাড়ি ছুটে আসছে না তো? আতঙ্কে ছিল পুলিশও। ছবি: এএফপি।

শনিবার রাতে লন্ডনে যে হামলা হয়েছে, এখনও কোনও জঙ্গি গোষ্ঠী তার দায় নেয়নি ঠিকই। কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন শহরই এই ধরনের হামলার আশঙ্কায় ছিল। আশঙ্কা যে এখনও রয়েছে, তা-ও ইউরোপীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি খোলাখুলিই স্বীকার করছে। গত বছরও রমজান মাসে ইউরোপে হামলার ডাক দিয়েছিল আইএস। এ বারও একই আহ্বান জানিয়েছে তারা। মধ্য এশিয়া থেকে মাথা তোলা জঙ্গি সংগঠনটি ইউরোপে যে খুব নিবিড় নেটওয়ার্ক তৈরি করে ফেলেছে, তেমন নয়। কিন্তু আইএস বা আল কায়েদার মতো জঙ্গি সংগঠন ইউরোপে বসবাসকারী মুসলিমদের এখন ধর্মের নামে সন্ত্রাসে উদ্বুদ্ধ করতে চাইছে। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে কেউ কেউ নিজে থেকেই কট্টরবাদে দীক্ষা নিচ্ছে বলে ইউরোপের বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা মনে করছে। সেই লোন উলফরা-ই বিভিন্ন শহরে একের পর হামলা চালাচ্ছে। রমজান মাসে ইউরোপের আরও নানা শহরে এই ধরনের হামলা হতে পারে বলেও গোয়েন্দাদের আশঙ্কা।

আরও পড়ুন: লন্ডন ব্রিজে গাড়ি নিয়ে হামলা, নিহত অন্তত ৭, খতম ৩ জঙ্গিও

আইএস এবং আল কায়েদার নেটওয়ার্ক যে ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে, তা ওই দুই জঙ্গি সংগঠনও জানে। কিন্তু কট্টরবাদীরা যে বিশ্বের নানা প্রান্তে রয়েছে এবং জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলেও যে তারা সন্ত্রাস ছড়াতে আগ্রহী, তা কারও অজানা নয়। এই সব কট্টরবাদীদের প্রতি অনেক দিন ধরেই আইএস বা আল কায়েদা খোলাখুলি আহ্বান জানাতে শুরু করেছে। নিজেদের উদ্যোগে যাতে তারা নাশকতা ঘটায়, তার জন্যই আহ্বান জানানো হচ্ছে। এই ধরনের নাশকতা কী ভাবে চালাতে হবে, ২০১০ সালে আল কায়েদা একটি ম্যাগাজিনে সে সংক্রান্ত প্রতিবেদনও ছেপেছিল। প্রতিবেদনের নাম ছিল, ‘দ্য আলটিমেট মোয়িং মেশিন’। মোয়িং মেশিন বা মোয়ার চালিয়ে যে ভাবে অত্যন্ত সহজে খেলার মাঠের ঘাস সমান ভাবে ছেঁটে ফেলা যায়, ভিড় রাস্তায় উন্মত্ত গাড়ি নিয়ে হামলা চালালে সে ভাবেই বহু মানুষকে পিষে দেওয়া যায়— এই ছিল প্রতিবেদনটির মূল উপজীব্য। সেই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল— বোমা বা বিস্ফোরক নিয়ে হামলা চালানো গেলে সবচেয়ে ভাল। না পারলে, বন্দুক নিয়ে হামলা চালানো যেতে পারে। চোখের নিমেষে ঝাঁঝরা করে দেওয়া যেতে পারে বহু মানুষকে। বন্দুক জোগাড় করা না গেলে, জনবহুল এলাকায় ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল সেই প্রতিবেদনে। আর তা-ও না পারলে গাড়ি বা ট্রাক নিয়ে পিষে দাও যত বেশি সম্ভব মানুষকে— পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল প্রতিবেদনটিতে। প্রবল বেগে ভিড়ের মাঝে ঢুকে পড়তে হবে, যত বেশি সম্ভব মানুষকে পিষতে পিষতে এগোতে হবে, এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গাড়ির উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত রাখতে হবে— তা হলেই সবচেয়ে বেশি মৃত্যু সুনিশ্চিত করা যাবে। এমন পরামর্শই দেওয়া হয়েছিল। ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে হওয়া হামলাগুলো যে আল কায়েদা এবং আইএস-এর দেওয়া এই গাইডলাইন অনুসরণ করেই হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য। ২২ মে এবং ৩ জুন— লন্ডনের এই দুই হামলায় হামলাকারীরা কিন্তু শুধু গাড়ি ব্যবহার করেনি। সঙ্গে ছুরিও নিয়েছিল। অর্থাৎ, আল কায়েদার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যে শেষ দুই পদ্ধতির কথা বলা হয়েছিল, সেই দুই পদ্ধতিই হয়ে উঠল লন্ডনের দুই হামলার হাতিয়ার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement