মাঝ আকাশে মারণহানা, হত ২৯৫

ইউক্রেনে ধ্বংস মালয়েশীয় বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র হানা ঘিরে চাপানউতোর

নিখোঁজ যাত্রিবিমান এমএইচ ৩৭০-এর হদিস আজও মেলেনি। মালয়েশীয় এয়ারলাইন্সের এমএইচ ১৭ ঘিরে অন্তত সেই অনিশ্চয়তা নেই। ২৯৫ জন আরোহী সমেত জ্বলে খাক হয়ে ইউক্রেনের মাটিতে আছড়ে পড়েছে সে। এমএইচ ৩৭০-র ক্ষেত্রে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে, বিমানটি দুর্ঘটনায় পড়ে না নাশকতার শিকার হয়। এমএইচ ১৭-র দিকে কিন্তু প্রথম থেকেই নাশকতার অভিযোগ নিয়ে চাপানউতোর শুরু হয়েছে।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

কিয়েভ শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৪ ০২:৫৬
Share:

নিখোঁজ যাত্রিবিমান এমএইচ ৩৭০-এর হদিস আজও মেলেনি। মালয়েশীয় এয়ারলাইন্সের এমএইচ ১৭ ঘিরে অন্তত সেই অনিশ্চয়তা নেই। ২৯৫ জন আরোহী সমেত জ্বলে খাক হয়ে ইউক্রেনের মাটিতে আছড়ে পড়েছে সে।

Advertisement

এমএইচ ৩৭০-র ক্ষেত্রে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে, বিমানটি দুর্ঘটনায় পড়ে না নাশকতার শিকার হয়। এমএইচ ১৭-র দিকে কিন্তু প্রথম থেকেই নাশকতার অভিযোগ নিয়ে চাপানউতোর শুরু হয়েছে। ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক অভিযোগ করছে, রুশপন্থী বিদ্রোহীরাই ক্ষেপণাস্ত্র হেনে বিমানটি নামিয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পরশেঙ্কো দাবি করছেন, এটি একটি জঙ্গি নাশকতার ঘটনা। মার্কিন গোয়েন্দাদের একটি সূত্রও ক্ষেপণাস্ত্র হানার কথা মেনেছে। বোয়িং ৭৭৭ বিমানটির ২৮০ জন যাত্রী এবং ১৫ জন বিমানকর্মীর কেউই বেঁচে নেই।

বৃহস্পতিবার দুপুরে আমস্টারডাম থেকে কুয়ালা লামপুরের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল এমএইচ ১৭। গন্তব্যে পৌঁছনোর কথা ছিল শুক্রবার ভোর ছ’টা নাগাদ। কিন্তু এ দিন বিকেল ৪টে ২০ মিনিট থেকেই বিমানটির সঙ্গে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সংযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। পরে রাশিয়ার সীমান্ত থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে পূর্ব ইউক্রেনের মাটিতে পাওয়া যায় তার ধ্বংসাবশেষ। জায়গাটা ডনেৎস্ক এলাকার গ্রাবোভো নামে একটি গ্রামের কাছে।

Advertisement

ডনেৎস্ক এলাকাটি রুশপন্থী বিদ্রোহীদের বড় ঘাঁটি বলে পরিচিত। রাশিয়া-ইউক্রেন চলতি সংঘাতের আবহে গত কয়েক দিন ধরেই দু’দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিমানে হামলা চালানোর অভিযোগ এনেছে। এ দিন সকালেও ইউক্রেনের একটি সামরিক বিমান রাশিয়া ধ্বংস করেছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। রাশিয়া অবশ্য সে অভিযোগ অস্বীকার করে। বিকেলে মালয়েশীয় যাত্রী বিমানটি ধ্বংস হওয়ার পরে সেই চাপানউতোরই আরও গতি পেয়েছে। তবে রাশিয়া এখনও এ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খোলেনি। সরকারি ভাবে উদ্ধার কার্যে সাহায্য করার প্রস্তাবই পাঠিয়েছে তারা। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কথা হয়েছে। কিন্তু রাশিয়া, আমেরিকা, ব্রিটেন কেউই ঘটনাটিকে সরাসরি ‘নাশকতা’ বলে উল্লেখ করেনি। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকও সন্ত্রাসের কথা বলেননি। মালয়েশীয় এয়ারলাইন্সও তাদের টুইটার পেজে বিমানটির সঙ্গে সংযোগ হারানোর খবরটুকুই প্রকাশ করেছে।

দুর্ঘটনা না নাশকতা, এ প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর তাই এখনই মিলছে না। কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার। এমএইচ ১৭ এই মুহূর্তে ইউক্রেন ও রাশিয়ার কূটনৈতিক লড়াইয়ে সব চেয়ে বড় ঘুঁটি। পরিস্থিতি এমনই ঘোরালো হয়ে উঠেছে যে, এ দিন রাতেই এয়ার ফ্রান্স, লুফৎহানসা, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ এমনকী রুশ বিমান সংস্থা এরোফ্লটও ইউক্রেনের আকাশপথ এড়িয়ে যাওয়ার কথা ভাবনা-চিন্তা করতে শুরু করেছে। শুধু তা-ই নয়, ইতিমধ্যে তাদের যে সব বিমানের ইউক্রেনের উপর দিয়ে যাওয়ার কথা, সেগুলিকেও অন্য আকাশ পথ দিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ।

ইউক্রেনের অভিযোগের কথা সবার আগে প্রকাশ করে রুশ সংবাদ সংস্থা ইন্টারফ্যাক্স। ইউক্রেনীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আধিকারিক আন্তন গেরাশচেঙ্কোকে উদ্ধৃত করে তারা জানায়, এই ঘটনায় রুশপন্থী বিদ্রোহীদেরই হাত দেখছে ইউক্রেন। গেরাশচেঙ্কো তার পর তাঁর ফেসবুক পেজে ক্রমান্বয়ে বোমা ফাটাতে থাকেন। তিনি দাবি করেন, বিদ্রোহীরা ‘বুক মিসাইল সিস্টেম’ ব্যবহার করে বিমানটি টেনে নামিয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্র ৭২ হাজার ফুট উচ্চতা পর্যন্ত আঘাত হানতে পারে। এমএইচ ১৭ ইউক্রেনের আকাশে ৩৩ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ছিল। ডনেৎস্ক এলাকার স্নিঝনে শহরে যে এ দিন সকালে বুক-এর মতো ক্ষেপণাস্ত্র দেখা গিয়েছে, এ কথা জানাচ্ছেন প্রত্যক্ষদর্শীরাও।

তবে সংবাদমাধ্যম একই সঙ্গে এ-ও বলছে, সাবেক সোভিয়েতের তৈরি বুক মিসাইল রুশপন্থী এবং ইউক্রেনপন্থী, দু’দলের কাছেই আছে। রুশপন্থীদের নেতা আন্দ্রেই পারগিন যদিও সংবাদসংস্থা এপি-র কাছে দাবি করেছেন, তাঁর অনুগামীদের কাছে বুক আছে কি না, তিনি নিশ্চিত নন। যদি থেকেও থাকে, সেটা ব্যবহার করার মতো সামর্থ্য তাদের নেই। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীই বিমানটি ধ্বংস করেছে। তার পর ইচ্ছাকৃত ভাবে রুশপন্থীদের উপরে দোষ চাপাচ্ছে। এর উত্তরে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট আবার জোর গলায় দাবি করছেন, তাঁর সেনারা এর পিছনে নেই। তারা কোনও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়েনি। ডনেৎস্ক-এর ইউক্রেনপন্থী প্রশাসন, ডনেৎস্ক পিপলস রিপাবলিক-ও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

কিন্তু জটিলতা আরও বাড়িয়েছেন রুশপন্থী বিদ্রোহীদের আর এক নেতা, ইগর গিরকিন ওরফে স্ত্রেলকভ। সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি আজ বিকেলে ফলাও করে লিখেছিলেন, তাঁরা ইউক্রেন বাহিনীর পণ্যবিমান আন্তনভ এএন ২৬-কে গুলি করে নামিয়েছেন। বলেছেন, “পূর্ব ইউক্রেনের উপর দিয়ে কোনও বিমান উড়তে দেব না আমরা, আগেই তো বলেছিলাম!” যে জায়গার নাম তিনি বলেছেন, সেটি টরেজ। ডনেৎস্ক থেকে মাত্র ৭০ কিমি দূরে।

ঘটনা হল, স্ত্রেলকভ এই কথা প্রকাশ করার পরপরই এমএইচ ১৭-র খবরটা সামনে এসেছে। তার পরেই ফেসবুকে ইউক্রেনীয় মন্ত্রকের কর্তা গেরাশচেঙ্কোর দাবি, দু’টো ঘটনা একই। বিদ্রোহীরা এএন ২৬-এর বদলে ভুল করে এমএইচ ১৭-কে আক্রমণ করেছে। পুতিনকে কটাক্ষ করে গেরাশচেঙ্কো লিখেছেন, “বাঁদরদের গ্রেনেড নিয়ে খেলতে দিলে যা হয়, তাই হয়েছে! আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে পুতিনকে জবাবদিহি করতে হবে।”

বিমানের ধ্বংসাবশেষ থেকে এ পর্যন্ত ১০০টি দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। জানা গিয়েছে, যাত্রীদের মধ্যে ৭১ জন ডাচ, ২৩ জন মার্কিন ও ৯ জন ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন। ফ্রান্স জানিয়েছে, চার জন ফরাসি নাগরিকের দেহ মিলেছে। জনবসতির উপর ভেঙে পড়ায় গ্রাবোভোর কিছু বাসিন্দাও এই দুর্ঘটনায় মারা যেতে পারেন বলে আশঙ্কা। উদ্ধার হয়েছে ব্ল্যাকবক্স।

ঘটনার পরপরই ইউটিউবে একটি ভিডিও আত্মপ্রকাশ করে। সেখানে একটি ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যাচ্ছিল। গ্রাবোভো গ্রামের এক বাসিন্দা, ভ্লাদিমির তখন মাঠে ট্রাক্টর চালাচ্ছিলেন। তিনি জানান, জ্বলন্ত পিণ্ডের মতো হু হু করে নেমে এসে প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিমানটি। উদ্ধারকারীরা গিয়ে দেখেন, ভগ্নস্তূপের মধ্যে যাত্রীদের ঝলসে যাওয়া দেহগুলো তখনও সিটবেল্ট দিয়ে আটকানো।

সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন ঘুরছে ডাচ নাগরিক কর প্যানের পোস্ট করা ছবি। এমএইচ ১৭ ছাড়ার আগে একটা ছবি তুলে পোস্ট করেন। ৮ মার্চ নিখোঁজ হওয়া এমএইচ ৩৭০-র প্রসঙ্গ টেনে লেখেন, “দেখো, উধাও হয়ে যাওয়ার আগে বিমানের ভিতর কেমন দেখতে লাগে!” তখনও জানেন না, কয়েক ঘণ্টা পরে কী ঘটতে চলেছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement