অরুণাচলে ভারতের সীমান্ত। ফাইল চিত্র।
পঁয়তাল্লিশ বছর আগের ২০ অক্টোবরের সঙ্গে সোমবার রাতে গলোয়ানের ঘটনার মিল সহজে নজরে আসবে না। কিন্তু মিল একটা রয়েছেই। সেদিনও ভারতীয় ভূখণ্ডে চিনা অনুপ্রবেশ প্রাণ দিয়ে রুখেছিলেন কয়েকজন অসম সাহসী ভারতীয় জওয়ান। ১৯৬২-র ভারত-চিন যুদ্ধের পর ১৯৬৭-র প্রায় পাঁচ দিন ধরে চলা সিকিমের সীমান্ত সংঘর্য অনেক বেশি রক্তক্ষয়ী এবং আলোচিত গোটা দেশ জুড়ে। কিন্তু ভারত-চিন সীমান্ত সংঘর্ষের ইতিহাসে অরুণাচলের তুলুঙ-লা-র ঘটনাই সোমবার রাতের গলোয়ানের ঘটনার আগে শেষ সংঘর্য যেখানে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ভারতীয় জওয়ানরা।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর দুই দেশের মধ্যে উত্তাপ বাড়ছিল। কিন্তু ১৯৭৫-এর ২০ অক্টোবর অরুণাচলে কোনও ধরনের উত্তাপের লেশমাত্র ছিল না। খুব রুটিন মেনেই সে দিন ভোর থেকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা ধরে টহলদারিতে বেরিয়েছিলেন অসম রাইফেলস-এর ২৫ ব্যাটালিয়নের জওয়ানরা। টহলের রাস্তায় শেষ জনপদ তাওয়াঙ জেলার থিঙবু-র মাগো গ্রাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ২৪০ মিটার উচ্চতায় থাকা মাগো গ্রাম ছেড়ে টহলদারি দল এগিয়ে যায় আরও ওপরে। হিমালয়ের কোলে দুর্গম এবং প্রত্যন্ত গিরিবর্ত্ম তুলুঙ-লায়ের দিকে। ভারতীয় ভূখণ্ড রক্ষায় মাগোর মতোই কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ৪ হাজার ৮৬৩ মিটার উঁচুতে থাকা ওই গিরিপথ।
প্রায় ১৫ দিন পরে সেনার একটি তার বার্তা প্রকাশ্যে আসে। জানা যায়, সে দিন তুলুঙ-লাতে পৌঁছনোর আগেই প্রায় ৫০০ মিটার দূরে চিনা বাহিনীর এলোপাথাড়ি গুলি বৃষ্টির মুখোমুখি হয় ভারতীয় টহলদার বাহিনী। সকলের অলক্ষে ওই গিরিপথের একটি দুর্গম অংশ দিয়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করে চিনা বাহিনীর গোটা একটি প্লাটুন। রাতারাতি পাথরের দেওয়াল খাড়া করে তার পিছন থেকে ভারতীয় টহলদার বাহিনী লক্ষ্য করে হামলা চালায় চিনা বাহিনী। ওই দিনের সংঘর্ষে মৃত্যু হয় অসম রাইফেলসের ৪ জন জওয়ানের। কিন্তু ওই টহলদার বাহিনী চিনা অনুপ্রবেশকারীদের পিছু হটতে বাধ্য করে। যদিও সে দিন চিনা বাহিনী অবস্থানগত ভাবে অনেক সুবিধাজনক জায়গায় ছিল।
আরও পড়ুন: বেজিংয়ে তীব্র হচ্ছে করোনার ‘দ্বিতীয় ঢেউ’, সতর্ক করল হু
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ভারত-চিনের মধ্যে সেই শেষ সংঘর্ষ যেখানে মৃত্যু হয়েছিল ভারতীয় সেনার। তার পর থেকে গত ৪৫ বছরে আরও মজবুত করা হয়েছে ওই এলাকার সেনা অবস্থান। ভারত-তিব্বত সীমান্ত পুলিশ এবং সেনার যৌথ নজরদারি চলছে সর্বক্ষণ। কিন্তু সে দিনের অনুপ্রবেশের ঘটনা শুনিয়ে এখনও সতর্ক করা হয়, ওই এলাকায় কর্মরত জওয়ানদের। কারণ তুলুঙ লা থেকে আরও দক্ষিণে সে লা গিরিপথে নিজেদের অবস্থান হারিয়েই ১৯৬২ সালে চিনা বাহিনীকে ভারতীয় ভূখণ্ডে বিনা বাধায় ঢুকে যাওয়ার রাস্তা করে দিয়েছিল ভারতীয় বাহিনীর ভুল সিদ্ধান্ত। সেই ঘটনার সাক্ষী এই মাগো। ওই গ্রামের উপর দিয়েই চিনের লাল ফৌজ ঢুকে পড়েছিল অরুণাচল প্রদেশের অনেকটা ভিতরে।
আরও পড়ুন: ভারত একতরফা সিদ্ধান্ত নিলে পরিণতি খারাপ হবে, হুঁশিয়ারি চিনের
ভারতীয় সেনার দাবি, ১৯৬২-র যুদ্ধ বাদ দিলে, ঠিক এরকম একতরফা হামলার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ১৯৬৭ সালে সিকিমে নাথু লা এবং চো-লায়ের সংঘর্ষ। ১১ সেপ্টেম্বর আচমকাই, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে চিনা বাহিনীর চৌকি থেকে এক সঙ্গে হামলা শুরু হয় নাথু-লা এবং চো-লার ভারতীয় সেনা চৌকি লক্ষ্য করে। ভারি গোলা বর্ষণের প্রাথমিক আকস্মিকতা কাটিয়ে পাল্টা জবাব দিতে থাকে ভারতীয় সেনা। কৌশলগত দিক থেকে দু’টিই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার উপরে থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দু’টি গিরিপথ। ওই গিরিপথগুলির উপর অধিকার হারানোর অর্থ— চিনা বাহিনীর অনুপ্রবেশের রাস্তা মসৃণ করে দেওয়া। টানা পাঁচদিন ধরে নিরন্তর সংঘর্ষ চলে। কিন্তু নাথু লা-তে অবস্থানগত সুবিধা ছিল ভারতীয় সেনার পক্ষে। পাল্টা হামলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে থাকে চিনের দিকে। শেষ পর্যন্ত এখানেও পিছু হটে চিনা বাহিনী। ১৯৬২-র যুদ্ধের পরে ভারত-চিনের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংঘর্ষ এটাই। ভারতীয় সেনার দাবি, ওই পাঁচ দিনের সংঘর্ষে অন্তত ৪০০ চিনা জওয়ানের মৃত্যু হয়েছিল। সেই ধাক্কা সামলাতে না পেরে সংঘর্ষে ইতি দিতে বাধ্য হয় চিন।