হামলাকারী উসমান খান। ছবি: এপি।
লন্ডন ব্রিজে বুধবার দুপুরে ছুরি নিয়ে দাপিয়ে বেড়ানো জঙ্গি উসমান খান পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত। আইএস দাবি করেছে, উসমান তাদের ‘যোদ্ধা’। আইএস- বিরোধী দেশগুলির জোটকে নিশানা করতেই তাদের হয়ে সে এই হামলা চালিয়েছে। তদন্তে জানা গিয়েছে, পাক জঙ্গি শিবিরে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল সে। সন্ত্রাসে জড়িত থাকার অপরাধে ২০১২-তে জেল হয় তার। কিন্তু সাজা শেষ হওয়ার আগে গত বছর হঠাৎ তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কেন এক দাগি অপরাধী ও জঙ্গিকে ছেড়ে দিল পাকিস্তান! কোনও জবাব মেলেনি ইসলামাবাদের কাছ থেকে।
লন্ডন পুলিশ জানিয়েছে, হামলাকারী জঙ্গির নাম উসমান খান। বয়স ২৮। আঞ্জেম চৌদারি নামে কুখ্যাত এক সন্ত্রাসবাদী নেতার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ছাত্র ছিল উসমান। ২০১০ সালে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে বিস্ফোরণের চক্রান্ত করেছিল আল কায়দা সমর্থক ন’জনের একটি দল। তার মধ্যে ছিল উসমানও। সে সময়ে তার বয়স ১৯। ওই বয়সেই পাক অধিকৃত কাশ্মীরে নিজেদের জমিতে জঙ্গি শিবির তৈরির ছক কষেছিল উসমান। সে জন্য ২০১১ সালে ব্রিটেন ছেড়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও করে ফেলেছিল সে। কিন্তু তার আগেই উসমান ও তার দলবলকে ধরে ফেলে লন্ডন পুলিশ। তাদের ডেরা থেকে পাওয়া নথিপত্র ঘেঁটে জানা গিয়েছিল, লন্ডনের তৎকালীন মেয়র বরিস জনসনের বাড়ি, মার্কিন দূতাবাস, সেন্ট পল ক্যাথিড্রালে হামলার ছক কষেছিল উসমানরা। বিগ বেন, লন্ডন আই, ওয়েস্টমিনস্টার প্যালেসেও নজরদারি চালিয়েছিল জঙ্গি দলটি।
সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অপরাধে ২০১২ সালে অনির্দিষ্ট কালের জন্য জেল হয় উসমানের। আদালত তাকে ‘কনিষ্ঠতম জঙ্গি’ বলে চিহ্নিত করেছিল। জানিয়েছিল, অন্তত ৮ বছর জেলে থাকতে হবে উসমানকে। তার পরে আরও কত দিন, তা নির্ভর করবে উসমানের গতিবিধির উপরে। অর্থাৎ কি না, প্রশাসন যত দিন মনে করবে, তত দিল জেলে বন্দি থাকতে হবে তাকে। কিন্তু ২০১৩ সালে সাজা কমিয়ে আদালত নির্দিষ্ট করে ১৬ বছরের কারাদণ্ড দেয় উসমানকে। যদিও আদালত আজ জানিয়েছে, গত বছর উসমানকে যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই সিদ্ধান্ত তারা নেয়নি।
প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আজ জানিয়েছেন, লন্ডন ব্রিজে হামলাকারী জঙ্গিকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া বড় ‘ভুল’ হয়েছে। উসমানকে ‘রিলিজ় অন লাইসেন্স’ শর্তে ছাড়া হয়েছিল গত বছর। এটি হল— ‘স্বাভাবিক জীবনে দ্রুত ফেরানোর জন্য বেশির ভাগ অপরাধীকে সাজার মেয়াদ ফুরনোর আগেই ছাড়া হয়। কিন্তু তাকে ২৪ ঘণ্টা পুলিশি নজরদারিতে রাখা হয়।’ গত কাল হামলার সময়েও ‘মনিটরিং ইলেকট্রনিক ট্যাগ’ পরেছিল উসমান। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর থেকে স্ট্যাফোর্ডশায়ার এলাকায় জেলফেরত আসামিদের একটি হস্টেলে থাকত উসমান। আজ সেখানেও হানা দেয় সন্ত্রাস দমন পুলিশের একটি দল।
গত কাল উসমানের ছুরির কোপে এক পুরুষ ও এক মহিলা নিহত হন। গুরুতর জখম তিন জন হাসপাতালে রয়েছেন। পরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় উসমানও। কাল নকল ‘সুইসাইড ভেস্ট’টি পরে প্রথমে লন্ডন ব্রিজের উত্তর দিকে ফিশমঙ্গার’স হলে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের একটি সেমিনারে ঢুকেছিল উসমান। বন্দিদের পুনর্বাসন নিয়ে সেমিনার চলছিল সেখানে। বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বাড়িটি উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় উসমান। তার পরে এলোপাথাড়ি ছুরি চালাতে থাকে। ছুরির আঘাতে প্রাণ হারান সেমিনারের অন্যতম উদ্যোক্তা ২৫ বছর বয়সি জ্যাক মেরিট। অনেকে জখম হন। এর পর সেমিনার হল থেকে বেরিয়ে এসে ব্রিজের উপরে পথচারীদের গায়ে ছুরি চালাতে থাকে সে। গত কালই পুলিশ জানিয়েছিল, কয়েক জন পথচারী ঝাঁপিয়ে পড়ে আততায়ীকে মাটিতে ফেলে তার থেকে ছুরি কেড়ে নেন। আজ কিছু ভিডিয়ো ফুটেজে দেখা গিয়েছে, ছ’জন লোক চেপে ধরে ফেলে দেন উসমানকে। এক জন অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নিয়ে আক্রমণ করেন, অন্য জন পাঁচ ফুট লম্বা তিমির দাঁত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন আততায়ীর উপরে। পরে জানা যায়, তিমির দাঁত হাতে লোকটি পোলিশ শেফ লুকাজ়। উসমানের ছুরিতে জখম হওয়ার পরেও তিনি পাল্টা হামলা করেন। পরে সংবাদমাধ্যমের কাছে বলেন, ‘‘ও আর যাতে কাউকে জখম করতে না পারে, সেটাই তখন মাথায় ঘুরছিল।’’ লন্ডনবাসীর চোখে লুকাজ়রা এখন ‘হিরো’। বাহবা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, লেবার নেতা জেরেমি করবিন ও ক্রেসিডা ডিক। তাঁদের কথায়, ‘‘মারাত্মক সাহসের পরিচয় দিয়েছেন ওঁরা। কুর্নিশ!’’