অতলান্তিক মহাসাগরে ঘেরা পান্না-রঙা দ্বীপ আয়ারল্যান্ডে রয়েছি গত দশ বছর। আইরিশ নাগরিকত্ব পাওয়ার পরে ২০১৮-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিয়েছি। সেই ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করি।
সে দিন বিকেলের দিকে ছেলেকে বললাম ‘‘চলো, ভোটটা দিয়ে আসি।’’ ভোটকেন্দ্র ছেলের স্কুলে। স্কুল শেষ হয়ে যাওয়ার পরে সেখানে ফের যাওয়ার সুযোগ পেয়ে ছেলে যতটা অবাক হল, তার থেকেও বেশি খুশি হল। ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে অবশ্য আমার অবাক হওয়ার পালা। পুলিশ নেই, ভোটারদের লম্বা লাইন নেই। বুথটাও নিতান্ত সাদামাঠা। সাধারণ প্লাইউড দিয়ে অস্থায়ী বুথ বানানো হয়েছে। সুতোয় বাঁধা পেন্সিল ঝুলছে। কাগজের ব্যালটে প্রার্থীদের নামের পাশে নিজের পছন্দ অনুযায়ী ১/২/৩ চিহ্নিত করে দিলেই কাজ শেষ। তিন মিনিটের মধ্যে নির্বিঘ্নে ভোট দিয়ে ফিরে এলাম।
এই দেশটা আয়তনে পশ্চিমবঙ্গের থেকেও ছোট। আর ভোটদাতার সংখ্যা যাদবপুর নির্বাচনক্ষেত্রের দ্বিগুণ। তবু ইভিএমে ভোটদান করিয়ে ওঠা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ২০০২-এ পরীক্ষামূলক ভাবে ইভিএমের ব্যবহার শুরু হয়। প্রচুর ভোটযন্ত্রও কেনা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছর পরেই সেই পরিকল্পনা প্রত্যাহার করা হয়। তার পর থেকে আবার কাগজ-পেন্সিলই ভরসা!
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
শুধু ভোট দেওয়াই নয়, এখানে পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াটাই হয় অন্য ভাবে। প্রার্থীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করেন। ভোটারদের নিজস্ব সমস্যার কথা মন দিয়ে শোনেন। এই ধরনের প্রচারকে এখানে বলা হয় ‘প্যারিশ পাম্প পলিটিক্স’, যাতে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক বিষয়ের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের সাধারণ সমস্যাই। পড়শির কুকুরটাকে বেঁধে রাখা হয় না, সে সব সময়ে চেঁচায়, এ ধরনের সমস্যার ঝুলিও প্রার্থীর সামনে খুলে বসা হয়। নির্বাচনী সভা হয় স্থানীয় ক্লাবের চার দেওয়ালের মধ্যে, আর দলীয় পৰ্যায়ের সভা হয়তো কোনও ভাল হোটেলে। বাড়ি বাড়ি বিলি হয় ছাপানো প্রচারপত্র। ছোট ছোট প্ল্যাকার্ড লাগানো হয় ল্যাম্পপোস্টের গায়ে। নির্বাচনের শেষে সে সব খুলে ফেলার দায় বর্তায় যারা লাগিয়েছে তাদেরই উপর।
নির্বাচনের ব্যয়ভার নিয়েও এ দেশের নিয়ম খুব কড়া। নির্দিষ্ট ব্যয়সীমা নির্ধারিত করা রয়েছে প্রত্যেক প্রার্থী ও প্ৰত্যেক দলের জন্য। এমনকি, কোন দল কত অনুদান পাবে, সেই সীমাও ধার্য করা থাকে। প্রত্যেক দলকে এক জন ‘জাতীয় এজেন্ট’ এবং প্রত্যেক প্রার্থীকে এক জন ‘নির্বাচনী এজেন্ট’ নিয়োগ করতে হয়। নির্বাচন চলাকালীন সমস্ত খরচখরচা নিয়ন্ত্রণ করা, ব্যয় সংক্রান্ত সমস্ত চুক্তি সই করা এবং নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সমস্ত ব্যয়ের সবিস্তার হিসেব জমা দেওয়া এই এজেন্টদেরই দায়িত্ব। তা না করলে সেটাকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
একই কেন্দ্র থেকে চার জন পর্যন্ত প্রার্থী নির্বাচিত করা যায়। মোট ৪০টি কেন্দ্র এবং এমপির সংখ্যা ১৫৮। ফলে একই কেন্দ্রে একটি দলের একাধিক প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারেন। লড়াইটা হয় ‘ফার্স্ট প্রেফারেন্স’ ভোট পেয়ে এক নম্বর হওয়ার। এমনও হয় যে, একই দলের একাধিক প্রার্থী পরস্পরের বিরুদ্ধে ‘ফার্স্ট প্রেফারেন্স’ ভোট পাওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
একটা দুঃখ থেকেই যায়। এখানে ছাপ্পা ভোটের অস্তিত্ব নেই, আঙুলে কালির দাগ দেওয়ারও প্রচলন নেই। ফলে ভোটের দিন বাঁ হাতের তর্জনীতে কালির দাগ দেখিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজস্বী পোস্ট করার শখটা কিছুতেই আর পূরণ করা হয় না!
লেখক দন্ত চিকিৎসক