—প্রতীকী ছবি।
বছর চারেক হল চিন থেকে আমেরিকায় এসেছে হাইচুন সি-এর পরিবার। বেশ কিছু দিন খোঁজাখুঁজির পরে ক্যালিফর্নিয়ার এই এলাকাটা ওঁদের মনে ধরেছিল। অরেঞ্জ কাউন্টির অভিজাত এলাকা লার্ডেন র্যাঞ্চ। গাছের ছায়ায় ঘেরা শান্ত এলাকা। গত বছর সেপ্টেম্বরে স্ত্রী আর দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে লার্ডেন র্যাঞ্চের একটি বাড়িতে উঠেছিলেন ৪৮ বছরের হাইচুন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে সেটি যে দুঃস্বপ্নের ঠিকানা হয়ে উঠবে তা ভাবতেও পারেনি ওই চিনা পরিবারটি। মাস দু’য়েক ধরে কমবয়সিদের একটা দলের তাণ্ডবে ওঁদের ঘুম উড়ে গিয়েছে। সন্ধে নামলেই হানা দিচ্ছে দলটা। জাতিবিদ্বেষমূলক হুমকি, গালাগালি তো আছেই। সঙ্গে বাড়ি লক্ষ্য করে যখন তখন উড়ে আসছে পাথর। কখনও লাগছে দরজায়। কখনও বা সশব্দে কাঁচ ভাঙছে। মধ্যরাতে বেজে উঠছে কলিং বেল। বাচ্চারা ভয়ে নিজেদের ঘরে ঘুমোতে পারছে না।
হাইচুনরা জাতিবিদ্বেষের শিকার। করোনা অতিমারি ছড়ানোর পর থেকে আমেরিকায় যে ভাবে জাতিবিদ্বেষ ও হিংসার ঘটনা বেড়েছে, তাতে উদ্বেগ বেড়েছে প্রশাসনের। একাংশের অভিযোগ, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনা ভাইরাসকে ‘চিনা ভাইরাস’, ‘কুং ফ্লু’— এ সব বলায় এশীয় বংশোদ্ভূতদের হেনস্থার ঘটনা বেড়ে গিয়েছে। নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অবশ্য বিদ্বেষ রুখতে নয়া নির্দেশিকা জারি করেছেন। কঠোর হাতে বিষয়টির মোকাবিলার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ ও প্রশাসনকে।
তবে হাইচুনরা তুলনায় ভাগ্যবান। তাঁদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন লার্ডেন র্যাঞ্চের প্রতিবেশীরা। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে সি পরিবার যখন চান্দ্র নববর্ষ উদ্যাপনে ব্যস্ত ছিলেন, তখন প্রথম ঝামেলার সূত্রপাত। তারপর থেকে প্রতিদিন একই তাণ্ডব। অন্ধকারে মুখঢাকা তাণ্ডবকারীদের সব সময় চেনাও যেত না। হামলাকারীদের ধরতে সিসি ক্যামেরা আর বেড়া লাগান হাইচুন। তবু অত্যাচার থামেনি। শেষে ঘটনাটি ভিডিয়ো করে স্থানীয় শেরিফকে জানান হাইচুন। তদন্ত শুরু হলেও হাতে-নাতে হামলাকারীদের ধরা যায়নি। তার পরে বিষয়টি প্রতিবেশী লায়লা পার্কের নজরে আনে সি দম্পতি। বছর তিরিশের লায়লা বলেন, ‘‘প্রথমে ভেবেছিলাম, কমবয়েসিরা মজা করছে। কলিং বেল বাজিয়ে চলে যাওয়ার ঘটনা আমার বাড়িতেও ঘটেছে। কিন্তু এখানে এসে বুঝলাম বিষয়টা কতটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে গিয়েছে। প্রতিটা দিন ওঁরা আতঙ্কে বাঁচছেন।’’
শি পরিবারকে বাঁচাতে লায়লা ফেসবুকে কমিউনিটি পেজ খুলে সাহায্য চান। ঠিক হয়, রোজ সন্ধে ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত প্রতিবেশীরা পালা করে সি-দের বাড়ি পাহারা দেবেন। স্বেচ্ছায় এই কাজে রাজি হয়ে যান অনেকেই। তার পর থেকে রোজই পালা করে রাত-পাহারা দিচ্ছেন লার্ডেন র্যাঞ্চের প্রতিবেশীরা।
রাতের তাপমাত্রা নেমে এলে, শি পরিবার কখনও কুকি-কফি, কখনও রাতের খাবার নিয়ে ওঁদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। কেউ বাড়ির উঠোনে চেয়ার পেতে, কেউ বা গাড়িতে বসে দূর থেকেই লক্ষ্য রাখেন ওই পরিবারের উপরে। হাইচুন জানিয়েছেন, রাত-পাহারা বসার পর থেকে ওঁরা শান্তিতে ঘুমোতে যান। তবে তাতে হেনস্থা যে পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে তা নয়। অন্ধকারে পাহারাদারদের দিকে কখনও উড়ে এসেছে ঢিল। কথনও গালাগালি। তাতেও মানুষের উপরে বিশ্বাস হারাননি হাইচুনরা। তবু চিন্তা থেকেই যায়। মানসিকতা না-বদলালে এ ভাবে চলবে কত দিন? উত্তর খুঁজে চলেন আমেরিকার এশীয় বাসিন্দারা।