রাষ্ট্রপুঞ্জে বৈঠক। —ফাইল চিত্র।
‘‘এই ভয়ের সিনেমা ভাল লাগছে? উপভোগ করছ তোমরা?’’ —গোটা বিশ্বের কাছে এই প্রশ্ন গাজ়ার আল শাটি শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা জ়াক হানিয়া-র। ইজ়রায়েলি সেনাবাহিনী লিফলেট বিলি করেছে এ অঞ্চলে। তাতে নির্দেশ, তিন ঘণ্টার মধ্যে ঘরবাড়ি ছেড়ে দক্ষিণ গাজ়ার দিকে রওনা দিতে হবে। কিন্তু তাঁরা যাবেন কী করে? হানিয়া জানিয়েছেন, উত্তর গাজ়া স্ট্রিপ থেকে দক্ষিণের দিকে যাওয়ার রাস্তা ভয়ানক হয়ে। বিদ্যুৎ নেই, ধ্বংসস্তূপের মাঝে নিকষ কালো অন্ধকারে ঢাকা পথ। যেন ভূতের সিনেমা চলছে। ক্ষোভ উগরে দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘মানুষের ভালর জন্য, এই বিশ্বের ভালর জন্য, রাষ্ট্রনেতাদের ভালর জন্য গাজ়ায় আর কত মানুষের মরে যাওয়া প্রয়োজন? কত মানুষের হত্যা হওয়া প্রয়োজন?’’
কাল হামাস-ইজ়রায়েল যুদ্ধের এক মাস পূর্ণ হবে। এই এক মাসে কত জন হামাস নেতার মৃত্যু হয়েছে, কেউ জানেন না। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে গাজ়ায় ১০,০২২ জন প্যালেস্টাইনি প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৪,১০৪টি শিশু। এ বাদ দিয়ে ২৫,৪০৮ জন জখম। ১৯২ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন। ৩২টি অ্যাম্বুল্যান্স জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৬টি হাসপাতাল বিদ্যুৎ, ওষুধ, স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের ১৮টি সংস্থার প্রধান ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি অবিলম্বে সংঘর্ষবিরতির ডাক দিয়েছে। তারা একত্রিত ভাবে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, ‘‘৩০ দিন হয়ে গেল। যথেষ্ট হয়েছে। এখনই যুদ্ধ বন্ধ হোক।’’ বিবৃতিতে ইউনিসেফ, ইউএন উইমেন, বিশ্ব খাদ্য প্রকল্প (দ্য ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র প্রধানরা লিখেছেন, ‘ইজ়রায়েলি হোক কিংবা প্যালেস্টাইনি, গত এক মাসের এই হত্যাকাণ্ড ভয়ঙ্কর।’
যদিও যুদ্ধ থামার কোনও লক্ষণ নেই। আজ আল-রানটিসি হাসপাতালে দু’বার হামলা চালিয়েছে ইজ়রায়েলি যুদ্ধবিমান। ৪ জন মারা গিয়েছেন। ৭০ জন জখম। হাসপাতালের সোলার প্যানেলগুলি ও জলের ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। আজ ক্যানসার হাসপাতালেও হামলা চলেছে। শিশু হাসপাতালগুলিকেও রেহাই দেওয়া হচ্ছে না। গোড়ায় হাসপাতালে হামলা নিয়ে ইজ়রায়েলের ব্যাখ্যা ছিল, এগুলি আসলে হামাসের ‘সন্ত্রাসঘাঁটি’। এখন আর তারা ব্যাখ্যা দেয় না। সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি পোস্টে দাবি করা হয়েছে, কমপক্ষে ১০০ ইজ়রায়েলি চিকিৎসক একত্রিত ভাবে সেনাবাহিনীর কাছে একটি পিটিশন জমা দিয়েছেন। তাতে গাজ়ার হাসপাতালে হামলার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। ওই পিটিশনে হিব্রুতে লেখা হয়েছে, ‘গাজ়ার মানুষ যখন হাসপাতালকে সন্ত্রাসের ডেরা করতে সম্মত হয়েছেন, তখন তাঁরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংসের কারণ।’ গাজ়ায় জলসঙ্কট চরমে। ইজ়রায়েলি বাহিনী উত্তর থেকে দক্ষিণ গাজ়ায় চলে যেতে বলছে মানুষকে, অথচ দক্ষিণের বেশির ভাগ জল রিজ়ার্ভার অকেজো। শরণার্থী শিবিরগুলোর ছোট্ট গণ্ডিতে উপচে পড়া ভিড়ে ডায়েরিয়া, শ্বাসকষ্ট-জনিত নানা রোগ ছড়াচ্ছে হু হু করে।
৭ অক্টোবর গাজ়ায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও পূর্ব জেরুসালেমে ‘দখলদারদের’ হামলা দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। এ নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। তারা জানাচ্ছে, কয়েকশো প্যালেস্টাইনি গত তিন সপ্তাহে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। এই ‘দখলদারেরা’ হলেন ইজ়রায়েলি নাগরিক, যাঁরা প্যালেস্টাইনিদের ব্যক্তিগত জমি দখল করে বসবাস করছেন। বিষয়টা এ রকম: বন্দুকের নলের সামনে প্যালেস্টাইনিদের বাড়ি থেকে বার করে দিয়ে সেখানে ইজ়রায়েলিরা থাকতে শুরু করেছেন। অভিযোগ, এদের নিরাপত্তা দিচ্ছে ইজ়রায়েল সরকার। এখন এমন ৭ লক্ষ দখলদারের বাস ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও পূর্ব জেরুসালেমে। বেশির ভাগ বসতিরই অনুমোদন দিয়ে রেখেছে খোদ ইজ়রায়েল সরকার। এদের এক-তৃতীয়াংশ অতিকট্টরপন্থী ইহুদি। ধর্মের কারণে তাঁরা ওই অঞ্চলে থাকতে শুরু করছেন। বাকিরা থাকছেন ইজ়রায়েল সরকারের ‘টোপে’। এই অঞ্চলে যে ইহুদিরা বাস করেন, তাঁদের বিশেষ অর্থসাহায্য ও ছাড় দেয় ইজ়রায়েল। রাষ্ট্রপুঞ্জের বক্তব্য, গোটা বিশ্বের নজর যখন গাজ়ার দিকে, তখন দখল হয়ে যাচ্ছে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক-ও।