আমেরিকায় বঙ্গ সম্মেলনের সেকাল একাল

বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ। নামটা অচেনা লাগছে তো? ৭১ সালে এই নামেই জন্ম নিয়েছিল আমেরিকা-প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন। বছর বছর বাড়তে লাগল সদস্য সংখ্যা। বছর চারেক নথিভুক্ত করার কথা ভাবা হয়নি। ১৯৭৪ সালে আমরা নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ পেলাম কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল গঠনের।

Advertisement

প্রবীর রায় (এনএবিসি-র কর্মকর্তা)

শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৬ ১৮:৩৭
Share:

বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ। নামটা অচেনা লাগছে তো? ৭১ সালে এই নামেই জন্ম নিয়েছিল আমেরিকা-প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন। বছর বছর বাড়তে লাগল সদস্য সংখ্যা। বছর চারেক নথিভুক্ত করার কথা ভাবা হয়নি। ১৯৭৪ সালে আমরা নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ পেলাম কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল গঠনের। সেখানে উল্লেখ ছিল একটি উদ্দেশ্য এবং চারটি লক্ষ্যের। গত চার দশকে এর কতটা আমরা পূরণ করতে পেরেছি সেটা বলবেন সদস্যরা, প্রতিনিধিরা, আমন্ত্রিত শিল্পীরা, অতিথিরা, যাঁরা বছর বছর ভরিয়ে রাখেন বঙ্গ সম্মেলনের মিলনমেলা। সংগঠকদের একজন হিসেবে আমার দায়িত্ব সবাইকে জানানো কী ছিল সেই সনদে।

Advertisement

উদ্দেশ্য হিসেবে উল্লেখ ছিল- বাংলার ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য এবং বাংলা ভাষার প্রচার।

এই মূল উদ্দেশ্য নিয়েই গত ৩৫ বছর ধরে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে বছরে একবার আয়োজন করা হ। বঙ্গ সম্মেলন। এবারও ব্যতিক্রম নয়। শিল্পী বাছাই থেকে মেনু তৈরি, সবেতেই বাঙালিয়ানার ছোঁয়া রাখার জন্যই বছরভর এতগুলো লোকের এত পরিশ্রম। বাংলা ভাষাকে ভালবেসে জড়ো হওয়া এক ছাদের নিচে।

Advertisement

লক্ষ্য-

১) বাংলা বই এবং জার্নালগুলো সংগ্রহে রাখার জন্য লাইব্রেরি তৈরি।

মাত্র ৬ বছরের মধ্যে আমরা আমেরিকা জুড়ে ২৩টি লাইব্রেরি তৈরি করেছিলাম। উত্তর আমেরিকা ও কানাডার বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা বই রাখার ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম। ২০০০ সাল পর্যন্ত এই নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন আমাদের সদস্যরা।

২) শিশুদের জন্য বাংলা ভাষার স্কুল, ক্লাস চালু করা, অবাঙালিরাও সেখানে বাংলা শিখতে পারবেন।

১৯৮০ সালের মধ্যে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে রবিবার বাংলা ক্লাস চালু করেছিলাম আমরা। স্থানীয় বাঙালিরা দায়িত্ব নিয়েছিলেন। স্কুলের সিলেবাস লিখে কপি করে বিভিন্ন শহরে পাঠাতাম আমরা। অনেক চেষ্টা করে কলম্বিয়া, ইয়েল, হার্ভার্ড-এর মতো নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মূল পাঠ্য তালিকায় বাংলাকে ঢোকাতে পেরেছিলাম। স্বীকার করতে অসুবিধা নেই, বেশ কিছু জায়গায় বাংলা ক্লাস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে অনেক কলেজে বাংলা শেখানো হয় আগের মতোই। ব্যক্তিগতভাবে অবাঙালিদের বাংলা শেখান কেউ কেউ।

৩)

নিউজ বুলেটিন চালু এবং প্রচার করার জন্য।

১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর চালু হল প্রথম হাতে লেখা পত্রিকা। ধীরে ধীরে কলেবর বেড়ে হল ২৪ পাতা। আজও মাসে দু’বার করে বের হয় আমাদের পত্রিকা।

আরও পড়ুন: বঙ্গ আবেগের জোয়ারে নিউ ইয়র্ক এখন মিনি কলকাতা

৪)

সাংস্কৃতিক, সামাজিক এূং বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান আয়োজন এবং প্রদর্শনী।

প্রথম প্রথম বিভিন্ন শহরে স্থানীয় বাঙালিরা ঘরোয়াভাবে নববর্ষ, রবীন্দ্র-জয়ন্তী, বিজয়া সম্মিলনী ইত্যাদি আয়োজন করতেন। এরপর আলোচনা শুরু হল কীভাবে এক ছাদের নিচে বিভিন্ন শহরের প্রবাসী বাঙালিদের একত্র করা যায়। এঁদের অনেকেই ভাল গানবাজনা, আবৃত্তি, নাচ, নাটক করেন। তাঁদের প্রতিভা তুলে ধরার জন্যও তো মঞ্চ দরকার।

আমাকে প্রথম ৬ বছরের জন্য কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল-র সভাপতি ও সম্মেলনের চেয়ারম্যান করা হল। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন রণজিৎ দত্ত। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বদেশ বসু, সত্যব্রত চৌধুরী, মীরা দাস, দীপক হালদার, মিহির সেন, প্রণব দাস, মনোরঞ্জন সিকদার, কল্যাণ ভট্টাচার্য, সুশান্ত রায় এবং আরও অনেকে।

১৯৮১ সালে প্রথম বঙ্গ সম্মেলন হল নিউ ইয়র্কে। কুইন্স-এর একটি স্কুলে জড়ো হলেন কাছাকাছি কয়েকটি শহরের বাঙালিরা। টরন্টো, বস্টন, নিউ জার্সি, মেরিল্যান্ড থেকে এলেন প্রবাসী শিল্পীরা। আমাদের সৌভাগ্য, ঘরোয়া আসর হলেও কলকাতা থেকে আমাদের উৎসাহ দিতে সে বার এসেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। দর্শক পেয়েছিলাম ২৬৫ জন আর টিকিটের দাম ছিল ৫ ডলার। আর যে নীতিটা আমরা প্রথম দিন থেকে আজও মেনে চলেছি, তা হল ধর্ম ও রাজনীতিকে দূরে রাখা।

পরের অংশ দেখতে ক্লিক করুন ২-এর উপরে

১৯৮২ সালে নিউ ইয়র্কেই দ্বিতীয় বঙ্গ সম্মেলনে পেয়েছিলাম উপেন্দ্রকিশোর মল্লিক ও স্বামী অভয়ানন্দজীকে। দর্শন এ সংস্কৃতের অধ্যাপক স্বামীজী ও তাঁর মা এক সময় বার্লিনে সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের জন্য কাজ করতেন। পরবর্তীকালে পন্ডিত নেহরু ও ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর। এক বছরের মধ্যে আমেরিকা প্রবাসী বাঙালিদের ভিতর প্রবল উৎসাহ দেখা দিল বঙ্গ সম্মেলন নিয়ে। সে বার দর্শক সংখ্যা একলাফে বেড়ে হল ৫০০-র বেশি।

কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল-এর কর্তারা মত দিলেন, বঙ্গ সম্মেলনকে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার আমেরিকার বিভিন্ন শহরে। ১৯৮৩ সালে নিউ ইয়র্কে সম্মেলনের আসর থেকেই ঘোষণা করা হল, পরের বছর থেকে নানা শহরে হবে এই মিলনমেলা। মনে আছে, সে বার এসেছিলেন লেখক শক্তিপদ রাজগুরু ও সুরকার সলিল চৌধুরী। উপচে পড়েছিল হল। সেবারই সবাই মিলে ঠিক করেছিলাম, প্রতি বছর সম্মেলনে এমন কোনও আমেরিকার ব্যক্তিকে সম্মান জানাব যিনি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেছেন।

১৯৪৮ সালে নিউ ইয়র্কের বাইরে পা রাখল বঙ্গ সম্মেলন। চতুর্থ সম্মেলনের আয়োজন হল বস্টনে। এমআইটি’র একটি হলে চমৎকার ব্যবস্থা করেছিলেন দিলীপ পাল। প্রধান অতিথি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডঃ রমা চৌধুরী এসেছিলেন ভারত থেকে। অনুষ্ঠানে বেশি লোক সমাগম না হওয়ায় বেশ ভেঙে পড়েছিলাম আমরা।

১৯৮৫-র সম্মেলন বাল্টিমোরে, মোটামুটি উতরে গেল নবদার প্রান্তিক গোষ্ঠীর উদ্যোগে।

পরের বছর কিন্তু জোরালো হাওয়া লাগল বঙ্গ সম্মেলনের পালে। ক্লিভল্যান্ডের জন ক্যারল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ শুভা সেন পাকড়াশি ও ডঃ রঞ্জিৎ দত্ত খুব পরিশ্রম করেছিলেন সম্মেলনকে সফল করার জন্য। প্রধান অতিথি হিসেবে আমরা পেয়েছিলাম বরেণ্য সাহিত্যিক শংকরকে। বাইরে থেকে আসা প্রতিনিধি ও অতিথিদের রাখার বন্দোবস্ত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্মিটরিতে। অনুষ্ঠানের পর সেখানে আড্ডা জমতো অনেক রাত পর্যন্ত! সেই প্রথম মনে হয়েছিল, বাঙালির মিলনমেলা সার্থক হল। সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি আড্ডা না হলে বাঙালির বদনাম!

১৯৮৭ সালে সান হোসে থেকে অনুরোধ জানালেন প্রবাসীর সভাপতি অপূর্ব মুখোপাধ্যায়, সপ্তম বঙ্গ সম্মেলন হোক সান ফ্রান্সিসকোতে। আগের সম্মেলনগুলোতে বেশির ভাগ লোক ছিল নিউ ইয়র্ক আর নিউ জার্সির। আশঙ্কা হল, অত দূরে নিয়ে গেলে লোক হবে তো? কোনও ঝুঁকি না নিয়ে অনেক আগেই ঘোষণা করা হল, এ বারের প্রধান অতিথি আলি আকবর খান সাহেব। এখানে একটা কথা বলা দরকার। সেই সময় কিন্তু বঙ্গ সম্মেলনের তহবিল যথেষ্ট ছিল না। মুখোপাধ্যায় আর তাঁর আমেরিকান স্ত্রীর বদান্যতায় সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা গিয়েছিল সে বার।

আমাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গিয়েছে এত দিনে। মার্কিন মুলুকের যে প্রান্তেই হোক না কেন, বঙ্গ সম্মেলনের টানে বাঙালি আসবেনই, বুঝে গিয়েছি আমরা। ফলে দিন দিন আরও রঙিন হয়ে উঠছে উৎসবের আবহ।

বাঙালিয়ানার বিচারে আমেরিকার অনেক শহর থেকে এগিয়ে রয়েছে যে নিউ জার্সি, ১৯৮৮ সালের বঙ্গ সম্মেলনের শহর সেটাই। সেখানকার নাম করা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী কল্লোল এগিয়ে এল লালমোহনদার নেতৃত্বে। নতুন সংযোজন হল বাংলা সংস্কৃতির প্রদর্শনী। দর্শক সংখ্যা ৪০০০ বেশি। সেই প্রথম হোটেলে রাখা হল অতিথিদের। প্রধান অতিথির আসনে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে পেয়ে আমরা আত্মহারা।

পরের বছর আবার ঘরে ফেরা, নিউ ইয়র্ক। আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। শুরুর সে দিন তো আর নেই। সাফল্যের রেশ ধরে না রাখতে পারলে মুখ থাকবে না। দায়িত্ব নিল মিলনী ক্লাব। সভাপতি ডঃ তপন সরকার আর অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়। একাধিক মঞ্চে অনুষ্ঠানের আয়োজন হল। প্রধান অতিথি শংকরীপ্রসাদ বসু এবং সুসাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। বিশেষ কিছু তো দিতে হবে, নিউ ইয়র্ক বলে কথা! গৌতম ঘোষকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এলাম আমরা, তাঁর ছবি অন্তর্জলি যাত্রা দেখে অভিভূত প্রবাসীরা।

৯০ সালে মেরিল্যান্ড। হিতব্রত রায়, যিনি বাচ্চুদা হিসেবেই বেশি পরিচিত, কলেজ পার্কে আয়োজন করলেন বঙ্গ সম্মেলন। অধ্যাপক ডায়োনাক সংবর্ধিত হলেন।

১১ বছরে পা দিয়েছে সম্মেলন। ম্যাসাচুসেটসে গোপা কুমার দায়িত্ব নিলেন। সে বার মঞ্চ আলো করেছিলেন দুই বিশ্বখ্যাত বিদ্বজ্জন – উইলিয়াম রাদিচে এবং কেতকী কুশারী ডাইসন।

একযুগ পেরিয়ে বঙ্গ সম্মেলন এ বার কানাডার টরন্টোতে। প্রবাসীর আয়োজনে কান্তি হোড়ের সভাপতিত্বে হল আয়োজন। আবার কাছে পেলাম সুনীলদাকে। সঙ্গে আর এক প্রিয় সাহিত্যিক বাণী বসু।

১৯৯৩ সালের বঙ্গ সম্মেলন হল গ্ল্যামারের পীঠস্থান লস অ্যাঞ্জেলেসে। প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করলেন যিনি, তাঁকে কিংবদন্তী বললেও কম বলা হয়। পন্ডিত রবিশংকর। বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন সাহিত্যিক সামসুল হক। অজিত রক্ষিত শক্ত হাতে সামলেছিলেন সব দিক।

পরের বার স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতিধন্য শিকাগোতে জমায়েত হল আমেরিকার বাঙালিরা। আমি আবারও সম্মেলনের চেয়ারম্যান। আর মিহির সেন সভাপতি। পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। সেই সময় আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন সিদ্ধার্থশংকর রায়। তাঁকে পেয়ে বেজায় খুশি হয়েছিলেন প্রবাসীর দল।

পরের অংশ দেখতে ক্লিক করুন ৩-এর উপরে

১৯৯৫-তে ১৫ বছর পূর্তি বলে কথা! সবার উৎসাহ তুঙ্গে। একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটল সে বার। সেই প্রথম চালু হল বিজনেস কনফারেন্স। আর সূচনাতেই সেখানে উপস্থিত পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, রাষ্ট্রদূত সিদ্ধার্থশংকর রায়। লোকসভার অধ্যক্ষ সোননাথ চট্টোপাধ্যায়, মৎস্যমন্ত্রী কিরণময় নম্দ। সঙ্গে বাংলার এক ঝাঁক শিল্পপতি। প্রায় ৮ হাজার বাঙালি ৩ দিন ধরে মেতে উঠেছিল বাংলার সুরে।

টেক্সাসে পরের বার একত্র হলাম আমরা। মরুভূমিতে আংলার প্লাবন বইল। সুরসিক মৃণাল চৌঝুরী ছিলেন আহ্বায়ক। প্রধান অতিথি বরেণ্য সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ।

১৭ তম বঙ্গ সম্মেলন হল ফিলাডেলফিয়াতে আর ১৮-তম টরেন্টোতে।

১৯৯৯ সালে প্রবাসী বাঙালির খুব আনন্জ। সান ফ্রান্সিসকোতে এলেন সুস্মিতা সেন এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।

২০০০ সালে পা দেওয়াটা চির স্মরণীয় করে রাখতে কী করা হবে, সেই পরিকল্পনা চলছিল অনেক দিন ধরেই। কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের আলোচনায় ঠিক হল, দুই শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে কলকাতা আর হাওড়ায় ১৩ দিন ধরে হবে বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ২৯ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি ১৪টা মঞ্চে হই হই কান্ড। সম্মেলনের চেয়ারম্যান হলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় আর আমি হলাম সভাপতি। সে কি উৎসাহ! ৭৪৫ জন শিল্পী অংশ নিয়েছিলেন উৎসবে। দর্শক এসেছিলেন লাখ দেড়েক।

২০০২ সালে ২২ তম বঙ্গ সম্মেলনের আয়োজন হল জর্জিয়া শহরের কনভেনশন সেন্টারে। চেয়ারম্যান অঞ্জন দত্তগুপ্ত। প্রধান অতিথি ছিলেন রসিক সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ। আর গ্ল্যামারের ছটায় বাঙালিকে আচ্ছন্ন করেছিলেন রাখী গুলজার।

পরের বছর ওশেন সিটিতে হল সম্মেলন। প্রাণপুরুষ সোমপ্রকাশ মজুমদার। প্রধান অতিথি হিসেবে এই প্রথম এলেন কোনও সংবাদপত্রের সম্পাদক। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার এসেছিলেন সে বার। চারপাশ উজ্জ্বল করে রেখেছিলেন জয়া ভাদুড়ি।

২০০৪ সালের বঙ্গ সম্মেলন বাল্টিমোরে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের দায়িত্বে ছিলেন অশোক মোতায়েদ। বিশেষ অতিথি হয়ে কলকাতা থেকে এলেন নবীন লেখিকা তিলোত্তমা মজুমদার। রেকর্ড ভিড় হয়েছিল সেবার, প্রায় ৮০০০ লোক।

রজত জয়ন্তী বর্ষের সমারোহে আমরা প্রবাসী বাঙালিরা ধন্য হলাম তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে পেয়ে।

২০০৬ সালের বঙ্গ সম্মেলন টেক্সাসের হিউস্টনে। মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসার দফতরের জন্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি এই শহরের। ভাস্কর রায় ছিলেন কর্মাধ্যক্ষ। বরেণ্য কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে পেয়েছিলাম সে বার। পরের বছর ডেট্রয়েটে দেবাশিস চক্রবর্তী দায়িত্ব নিলেন। নবনীতা দেবসেনের মতো একাধারে বিদগ্ধ ও রসিক সাহিত্যিককে পেলাম আবার। সঙ্গে নবকুমার বসু।

২০০৮ সালে টরেন্টোতে আর ২০০৯ সাল সান হোসে। আবার সুনীলদা, আবার তুমুল হৈ চৈ। আরও এক গুণীজনকে পেলাম আমাদের মাঝখানে। ডঃ কালীপ্রদীপ চৌধুরী। প্রবাসী এই বিদ্বান মানুষটির সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ গভীর, যাদবপুরের কে পি সি হাসপাতাল পশ্চিমবঙ্গের প্রথম বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ। পরবর্তী বঙ্গ সম্মেলন আয়োজিত হল নিউ জার্সির কল্লোল গোষ্ঠীর তত্ত্বাবধানে। আটলান্টিক সিটির কনভেনশন সেন্টারে।

২০১১ সালে ফের ঘুরেফিরে বাল্টিমোর। রমা সাহা উদ্যোক্তা হিসেবে রীতিমতো সফল।

পরের বছর ৩২ তম বঙ্গ সম্মেলন এক আশ্চর্য শহরে- লাস ভেগাস। ও দিকে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদল হয়ে গিয়েছে তার আগের বছর। এ বার প্রধান অতিথি হিসেবে পেলাম অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে।

আবার টরেন্টো। প্রবাসীর আয়োজনে জয়দেব সরকারের নেতৃত্বে জমে উঠল বাঙালির বাৎসরির মিলনমেলা। কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে অরল্যান্ডের ৩৪ তম বঙ্গ সম্মেলন করল বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ ফ্লোরিডা। কলকাতা থেকে এলেন আজকের জনপ্রিয় কবি শ্রীজাত। প্রধান অতিথির আসনে আমরা পেলাম দুই বিশ্ববরেণ্য বাঙালিকে — ডঃ মণি ভৌমিক এবং ডঃ পরিতোষ চক্রবর্তী।

দেখতে দেখতে ৩৫ বছর পেরিয়ে গেল। হিউস্টনের জর্জ ব্রাউন কনভেনশনের সেন্টারে বসল বঙ্গ সম্মেলনের আসর। আমজাদ আলি খান থেকে শ্রেয়া ঘোষাল, মাছের কালিয়া থেকে রসমালাই, কোনও ক্রুটি রাখেননি দুই কার্যকরী সভাপতি শঙ্কু বসু ও তপন বসু। এই প্রথম বাংলাদেশ এত বড় আকারে যোগ দিল বঙ্গ সম্মেলনে।

আরও একটা ব্যাপারে প্রবাসী বাঙালির মধ্যে বিপুল উৎসাহ দেখা দিয়েছিল। সম্মেলনের তিনদিন বাংলা সংবাদপত্রের বিশেষ সংস্করণ বেরলো হিউস্টন থেকে। কাড়াকাড়ি সেই কাগজ নিয়ে হাতেগরম সম্মেলন— সংবাদ পড়ার জন্য। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল শ্যামল সেন ও সাংসদ সুগত বসু এলেন। নেতাজীর পরিবারের কৃষ্ণা বসুকেও আমরা পেলাম। এন এ বি সি- আজকাল বিশ্বের সেরা বাঙালি পুরস্কারে সম্মানিত করা হল গায়িকা শ্রেয়া ঘোষাল, অভিনেত্রী কঙ্কনা সেনশর্মা, সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ও নবকুমার বসু এবং আমাকে।

এ বছর আমরা মহা সমারোহে বঙ্গ সম্মেলনের আয়োজন করছি নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে। ওয়েবসাইটে শিল্পী ও আমন্ত্রিত তালিকা দেখে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে বাঙালিরা গত এক বছর ধরে যোগাযোগ করেছেন আমাদের সঙ্গে। এ বারে ডেলিগেট সংখ্যা আগের সব বছরকে ছাপিয়ে যাবে বলে আসা করছি।

পরিশেষে একটা কথা না বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তবে প্রথমেই বলে রাখি এই মতামত সম্পূর্ণ ভাবেই আমার ব্যক্তিগত। যে উদ্দেশ্য নিয়ে বঙ্গ সম্মেলন শুরু হয়েছিল দীর্ঘ ৩৫ বছর আগে, তার থেকে হয়তো অনেকটাই সরে এসেছি আমরা। বলা ভাল, যুগের নিয়মে সরে আসতে হয়েছে। ইন্টারনেটের দৌলতে বই পড়ার অভ্যাস কমে গিয়েছে সর্বত্র। তাই ২০০০ সালের পর বন্ধ হয়ে গিয়েছে আমাদের তৈরি করা লাইব্রেরিগুলো। প্রথম দিকে বঙ্গ সম্মেলনে যে ঘরোয়া পরিবেশ ছিল, স্বাভাবিক ভাবেই আজকের বিশাল আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে তা আশা করা যায় না। এক দিকে বেড়েছে দর্শক সংখ্যাস অন্য দিকে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সমারোহ। বাজেট বেড়েছে লাফিয়ে, সামাল দিতে স্পনসর ডাকতে হয়েছে। আমাদের মতো প্রবীণদের হয়তো নস্টালজিয়া জাগতে পারে ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না’ বলে। কিন্তু বাস্তবে যে বলিউডের শিল্পী না আনলে চলবে না, এই সত্য সবাইকে মেনে নিতেই হবে। তা ছাড়া এই প্রজন্মের বাঙালিকে টানতে গেলে বিনোদনের প্যাকেজ চাই। না হলে আগামীদিনে কার হাতে দিয়ে যাব বঙ্গ সম্মেলনের ব্যাটন?

ছবি ফেসবুক এবং টুইটারের সৌজন্যে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement