ভাই যে আইএস জঙ্গিগোষ্ঠীতে যোগ দিয়ে জেহাদি জল্লাদ হয়ে উঠেছে, সে কথা জানতে পেরে আপাত ভাবে হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন তিনি। সংবাদমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘‘পুলিশের সন্দেহ সত্যি হলে, নিজের হাতে খুন করব দাদাকে।’’
কয়েক দিনের মধ্যেই আইএস-এর বাঙালি জঙ্গি সিদ্ধার্থ ধরের বোন কণিকা নিজেই কিন্তু স্বীকার করলেন, সিরিয়া চলে যাওয়ার পরেও দাদার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর। দাদা ফোন করত বাড়িতে, কথাও হতো। ব্রিটেন ছেড়ে সিরিয়া পালানোর সময়ই সিদ্ধার্থ বোনকে বলে গিয়েছিল, সে মরতেও প্রস্তুত!
লন্ডনে থাকতেই সিদ্ধার্থ মৌলবাদী প্রচারে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিল। ছ’-ছ’বার গ্রেফতারও হয়েছিল। ২০১৪ সালে শেষ বার গ্রেফতার হওয়ার পরে জামিন পেয়েই সস্ত্রীক সিরিয়া চলে যায়। আইএস-এর ভিডিওতে সম্প্রতি মুখোশ-পরা এক ঘাতককে সিদ্ধার্থ বলে সন্দেহ করছেন ব্রিটিশ গোয়েন্দারা। তার পরেই এই বঙ্গতনয়কে নিয়ে সংবাদমাধ্যম তোলপাড়। উত্তর লন্ডনের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা ধর পরিবার তখন দাবি করেছিল, সিদ্ধার্থর এই পরিণতি দেখে তাঁরা স্তম্ভিত। সিদ্ধার্থর মা সবিতা ধর আনন্দবাজারকে বলেছিলেন, তাঁরা কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। আকস্মিক এই আঘাতে এতটাই ভেঙে পড়েছেন তাঁরা। কণিকার এখনকার কথাবার্তায় স্পষ্ট হয়ে গেল, আইএস ভিডিওর জঙ্গি যে তাঁর দাদা, সেটা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ আর নেই বললেই চলে। এবং সিদ্ধার্থর এই গতিবিধি তার পরিবারের কাছে অজানাও ছিল না।
ব্রিটেনের প্রথম সারির সংবাদপত্রে এখন কণিকা জানাচ্ছেন, সিরিয়া থেকেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল সিদ্ধার্থ। গত অক্টোবরেও বোনকে ফোন করে অভয় দিয়ে বলেছিল, ‘‘মনের জোর রাখো, চিন্তা কোরো না।’’ কণিকার কথায়, ‘‘সিরিয়া যাওয়ার পরপরই আমি ওকে সতর্ক করেছিলাম। বলেছিলাম, ফিরে এসো। জানিয়েছিলাম, তোমরা এসে আমাদের সঙ্গে থাকলে ভাল লাগবে।’’ কণিকা জানিয়েছেন, সিদ্ধার্থ সে কথা মানতে চায়নি। তার ভয় ছিল, ব্রিটেনে ফিরলেই পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করবে।
এই ভয়ের কারণ যে শুধু গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব-অভিজ্ঞতা নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু— সেটাও ওই সংবাদপত্রেই অন্য একটি নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে। ব্রিটিশ পুলিশ সূত্রকে উদ্ধৃত করে ওই দৈনিকে বলা হয়েছে, ব্রিটিশ গোয়েন্দারাও সিদ্ধার্থ ওরফে আবু রুমায়েশের জঙ্গি কার্যকলাপ সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত ছিলেন। সিদ্ধার্থকে সেই ভাবেই নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৫ চেয়েছিল ‘ডবল এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করুক সিদ্ধার্থ। অর্থাৎ জঙ্গিদের মধ্যেই জঙ্গিদের এক জন হয়ে থেকে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের চর হয়ে থাকুক। আর তাই সব জেনেও সিদ্ধার্থকে ছেড়ে রাখা হয়েছিল গারদের বাইরে। যাতে তাকে নজরবন্দি করে রেখে খবর মেলে সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘরের। জানা যাচ্ছে, গোয়েন্দাদের তরফে চাকরির প্রস্তাব নিয়ে দু’-দু’বার যোগাযোগ করা হয়েছিল সিদ্ধার্থের সঙ্গে। প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাঁদের হয়ে গুপ্তচরের কাজ করতে। বলা হয়েছিল, ‘‘ব্রিটেনে তোমার জারিজুরি শেষ। সিরিয়ায় গেলে ড্রোন হানায় মরবে। অতএব পড়ে রয়েছে একটাই পথ— এমআই৫-এর হয়ে কাজ করা।’’
গোয়েন্দারাই জানাচ্ছেন, এক দিন হঠাৎ রাস্তায় এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির সঙ্গে ধাক্কা খায় সিদ্ধার্থ। সেই ব্যক্তি সিদ্ধার্থকে জানান, সে নজরবন্দি। অতর্কিত এই অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বাম্প’। এক গোয়েন্দা কর্তা বলছেন, ‘‘এটা এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করার কৌশল। ওকে বলা হতো, ‘তুমি কে আমরা জানি। কী করছ, জানি। কার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছ, তা-ও জানি। তোমাকে আমরা ধরে ফেলেছি...।’’ এ সবেরই কিছু দিন পর, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে নিষিদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী আল মুহাজিরৌন-এর সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করা হয় কট্টরপন্থী নেতা আঞ্জেম চৌধুরি ও সিদ্ধার্থকে। এক গোয়েন্দাকর্তার দাবি, ‘‘দেশের জন্য সম্ভাব্য আতঙ্ক ছিল সিদ্ধার্থ, কিন্তু একই সঙ্গে সম্ভাব্য সম্পদও।’’ তাই ফের নজরবন্দি করার জন্য কিছু দিন পরেই জামিনে মুক্তি দেওয়া হয় তাকে। সেই ফাঁকেই পালায় সিদ্ধার্থ। তার এই পালানো নিয়ে এখন ব্রিটেন জুড়ে ঝড়। গোয়েন্দা-পুলিশের গাফিলতি নাকি হিসেবের ভুল, তাই নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে। ‘‘কিছু একটা ভুল হয়েছিল... নিশ্চয় হয়েছিল,’’ আক্ষেপ ব্রিটিশ প্রশাসনের। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড যখন পাসপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য তলব করে, সিদ্ধার্থ তখন বহু দূরে। আইএস-সাম্রাজ্যে।
কণিকা এখনও বলছেন, সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাওয়ার চেয়ে তিনি চান দাদা ব্রিটেনের কারাগারে থাকুক। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের কাছে তাঁর কাকুতি, ‘‘দয়া করে ড্রোন হানা চালাবেন না। আমি নিশ্চিত, দাদার মগজধোলাই করা হয়েছে। ওর এই পরিণাম আমরা কেউ মেনে নিতে পারছি না, তবু দাদা তো!’’