— ফাইল চিত্র
সব আয়োজন ভেস্তে যেতে বসেছিল ইলিং পুজো কমিটির। পুরোহিত না থাকলে পুজো করবেন কে?
ধারেভারে এই পুজোর আলাদা কদর লন্ডন আর তার আশপাশে। খোদ ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার এর সঙ্গে জড়িত। দুর্গাপুজোকে গোটা বিশ্বের কাছে তুলে ধরা এবং এই উৎসবের প্রচারের দায়িত্বে রয়েছে ইলিং কমিটি। ইলিং টাউন হলে বাঙালি ও অবাঙালি পরিবার মিলে এই পুজো করছে গত ১০ বছর ধরে। ৬ হাজার লোক পাত পেড়ে খান। সরাসরি ভিডিয়ো কনফারেন্সে কলকাতার একাধিক পুজোর সঙ্গে এদের যোগ থাকে। কলকাতার বালিগঞ্জ কালচারালের ঢাক বাজে আর ‘লাইভ’ তা ভিডিয়ো কনফারেন্সে দেখে ও শুনে তার তালে নাচেন ইলিংয়ের বাঙালিনী! সরাসরি লন্ডন বনাম কলকাতা অন্তাক্ষরী প্রতিযোগিতাও হয়।
এ হেন বিখ্যাত পুজোয় ১০ বছর ধরে যিনি পুরোহিতের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন, সেই অমিয় ভট্টাচার্য গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। দিন কয়েক নাওয়াখাওয়া ভুলে চার দিক তোলপাড় করার পরে পিনাকী গঙ্গোপাধ্যায় নামে এক বঙ্গসন্তানকে পাওয়া গেল। তিনি ডালাসে থাকতেন, সেখানকার পুজো করতেন। মাত্র কয়েক মাস আগে বদলি হয়ে এসেছেন। তাঁকে রাজি করানো হল। কমিটির অন্যতম সদস্য অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় টেলিফোনে বলছিলেন, ‘‘লন্ডনে পুজোর সব উপকরণ পাবেন। কিন্তু পুরোহিত পেতে কালঘাম ছুটে যাবে। পুজোর আগে পুরোহিত নিয়ে টানাটানি চলে। এক কমিটির পুরোহিতকে অন্য কমিটি হাইজ্যাক করে নিয়ে যায়।’’
পশ্চিম লন্ডনের আদি শক্তি পুজো কমিটির তরফে সৌম্য গুপ্ত ফোনে জানাচ্ছিলেন, এই চাহিদা বা টানাটানি খুব স্বাভাবিক। কারণ, লন্ডন আর তার আশপাশে পুজো ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে। দশ জন বাঙালি এক জায়গায় হলে যেমন দুর্গাপুজো করে ফেলে তেমন কিছু দিনের মধ্যে ঝগড়াও বাধায়। আলাদা হওয়া অংশ একটা নতুন পুজো শুরু করে। এই হারে তো আর নতুন পুরোহিত বিদেশ বিভুঁইয়ে তৈরি হয় না। তার উপর বিদেশে পুজো করার জন্য আলাদা ক্ষমতা বা দক্ষতা প্রয়োজন। পাঁচ দিনের পুজো দু’দিন এমনকি এক দিনেও সেরে ফেলতে হয়। তার মধ্যে বোধন, কলাবৌ স্নান, সন্ধিপুজো থেকে দেবীবরণ—সব রাখতে হয়। সবাই তা পারেন না। ফলে শেষ মুহূর্তে কেউ গুজরাতি পুরোহিত দিয়ে পুজো সারে, কোনও কমিটি আবার গুচ্ছের টাকা গচ্চা দিয়ে দেশ থেকে পুরোহিত উড়িয়ে আনে।
এখন অবশ্য কিছু-কিছু জায়গায় ‘ইচ্ছুক’ বাঙালিদের পুরনো পোড় খাওয়া পুজো-করিয়েরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। কেউ-কেউ নিজের আগ্রহে বই পড়ে, ইন্টারনেট ঘেঁটে পুজোপদ্ধতি শিখে কাজ চালিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। যেমন সুইনডেনের চিকিৎসক সুরজিৎ মুখোপাধ্যায়। তিনিই এখন সেখানকার দুর্গাপুজোর দায়িত্বে। সুইনডেনের বাসিন্দা উজ্জ্বয়িনী মজুমদার টেলিফোনে বলেন, ‘‘এখানে পুরোহিত পাওয়া মানে লটারি পাওয়ার মতো। কোথাও কেউ পুজো করতে জানেন শুনলে এক বছর আগে থেকে তাঁকে ‘বুক’ করে রাখা হয়। এখন তো পুরোহিতের আকাল চরমে উঠেছে।’’
প্রায় পনেরো বছর আগে লন্ডনে বসত করেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার তনয় মুখোপাধ্যায়। এখন তিনি সেখানকার প্রতিষ্ঠিত ‘প্রপার্টি ইনভেস্টমেন্ট কনসালটেন্ট।’ আর তাঁর নেশা পুরোহিতের কাজ। দেওঘর রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্রটি স্কুলজীবনে পুজোপাঠ, হোমযজ্ঞ শিখেছিলেন। তা এখন ভরপুর কাজে লাগছে। তাঁকে নিয়ে কার্যত টানাটানি চলে দুর্গাপুজোয়। টেলিফোনে বললেন, ‘‘চার দিনের পুজোটাকে ছোট করে ফেলাটাই সবচেয়ে কঠিন।’’
লন্ডনে সশিষ ডাব মেলে না। কাজ চালাতে হয় নারকেলে। শিউলি পদ্মের বদলে মেলে ক্রিসেনথেমাম, রেড কার্নিশন। হোম করার সময় অনেক সময়ে হলে ফায়ার অ্যালার্ম বেজে ওঠে। সব কিছু সামলে পুজো শেষ হলে ছাঁদা বেঁধে সঙ্গে দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয় ঠাকুরমশাইকে। আর তাঁর কাছ থেকে আদায় করে নেওয়া হয় আগামী বছর উপস্থিত থাকার প্রতিশ্রুতি।