নরেন্দ্র মোদী (বাঁ দিকে) ও শি চিনফিং। —ফাইল ছবি
অস্বস্তিটা শুরু হয়েছিল ২০১৭-র ডিসেম্বর থেকে। নয়াদিল্লির সেই অস্বস্তিকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র মলদ্বীপের চিনপন্থী প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামিন সেনা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন দেশের পার্লামেন্টে। ভারতের বিরুদ্ধে ক্রমশ সুর চড়াতেও শুরু করেছিলেন। দীর্ঘ ন’মাসের টানাপড়েন কাটিয়ে শেষ হাসি কিন্তু হাসতে চলেছে ভারতই। মলদ্বীপের নতুন প্রেসিডেন্টের শপথে সর্বোচ্চ স্তরের বৈদেশিক নেতা হিসেবে যোগ দিতে চলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
১৭ নভেম্বর মলদ্বীপের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিতে চলেছেন ইবু সোলিহ্। সেই উপলক্ষে দিনভর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হাজির থাকবেন মলদ্বীপের রাজধানী মালে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে সঙ্কট তীব্র হতে শুরু করেছিল মলদ্বীপে। জরুরি অবস্থা জারি করা, পার্লামেন্টে সেনা অভিযান, বিরোধী পক্ষের প্রায় সব শীর্ষনেতাকে জেলে ভরে দেওয়া, দেশের প্রধান বিচারপতিকে গ্রেফতার করানো— একের পর এক স্বৈরাচারী পদক্ষেপ করে ক্ষমতা ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টা করছিলেন পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে ফেলা প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামিন। চরম সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি করছিলেন নিজের দেশে।
সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে মলদ্বীপের বিরোধী দলগুলো ভারতের হস্তক্ষেপ চাইতে শুরু করেছিল। ভারত সরকার কড়া বিবৃতি দিয়ে আবদুল্লা ইয়ামিনের পদক্ষেপগুলোর নিন্দাও করেছিল। কিন্তু চিন প্রকাশ্যেই সমর্থন ব্যক্ত করেছিল ইয়ামিনের প্রতি। মলদ্বীপে ভারতের হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া হবে না, বেজিঙের তরফে এমন বার্তাও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল।
আরও পডু়ন: মুখবন্ধ খামে রাফাল চুক্তির তথ্য সুপ্রিম কোর্টে জমা দিল কেন্দ্র
প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের সরকার যে ভাবে ভারতের প্রভাব খর্ব করে নিজের দেশে লাল কার্পেট বিছিয়ে দিচ্ছিলেন চিনের জন্য, তার প্রতিদানেই ইয়ামিনকে সমর্থন করছিল চিন। বাইরের কোনও শক্তি মলদ্বীপে হস্তক্ষেপ করলে চিনও সক্রিয় ভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের সমর্থনে মাঠে নামবে বলে বেজিং বুঝিয়ে দিচ্ছিল।
কূটনীতিকদের একাংশ বলেন, ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটিতে ভারতের প্রভাব খর্ব করে নিজেদের ব্যবসা বাড়াতে এবং সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে চিন বহু দিন ধরেই সক্রিয় ছিল। কিন্তু আশির দশকের শেষ দিকে শ্রীলঙ্কার তামিল সন্ত্রাসবাদীদের কবল থেকে মলদ্বীপের সরকারকে যে ভাবে রক্ষা করেছিল ভারতীয় বাহিনী, তা ভোলেনি দ্বীপরাষ্ট্রটি। চিনের নানা রকম কৌশল সত্ত্বেও ভারতের দিকেই ঝুঁকে ছিল মলদ্বীপ।
মলদ্বীপের হবু প্রেসিডেন্ট ইবু সোলিহ্।
চিন অবশ্য চেষ্টা ছাড়েনি। নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মায়ানমার— ভারতের প্রতিটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রে গত কয়েক দশক ধরে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা যে ভাবে চালিয়ে যাচ্ছিল চিন, সে ভাবেই সক্রিয় ছিল মলদ্বীপেও। ২০১১ সাল পর্যন্ত মলদ্বীপে দূতাবাসও ছিল না চিনের। কিন্তু অন্য দেশগুলিতেও যে ভাবে অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে চিন প্রভাব বাড়িয়েছে, মলদ্বীপেও ড্রাগন শেষ পর্যন্ত অনুপ্রবেশ করে সেই পথেই। ২০১২ সালে মলদ্বীপে সামরিক অভ্যুত্থানের সুযোগ নিয়ে প্রভাব বাড়াতে শুরু করে বেজিং। ২০১৭-র ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামিনের সরকারের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করে চিন। একের পর এক ভারতীয় প্রকল্পের কাজ আটকে দিতে শুরু করে। ভারতের কাছ থেকে যে সব সামরিক সাহায্য এক সময়ে চেয়েছিল মলদ্বীপ, সেই সব সাহায্যই আচমকা প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করে ইয়ামিনের সরকার। চিনা সংস্থাগুলোর জন্য ব্যবসার রাস্তা প্রশস্ত করা হয়। চিনকে সামরিক ঘাঁটি তৈরির জন্য জমিও দেওয়া হয়।
আরও পডু়ন: মালয়েশিয়ায় ক্যাসিনো খুলে এ রাজ্য থেকে মানুষ পাচারের ব্যবসা কবীরের!
ভারত সরকার বেজায় অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল মলদ্বীপের এই পরিস্থিতির জেরে। ভারত-চিন সম্পর্ক এবং ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার প্রশ্নে মলদ্বীপের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভারতের জন্য। কিন্তু দ্বীপরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যে ভাবে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর জন্য এবং ভারতীয় সংস্থা ও ভারতীয় পেশাদারদের জন্য নিজের দেশের দরজা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে শুরু করেছিলেন, তাতে ভারতীয় জলসীমার নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে পড়ে যাচ্ছিল। ভারতের সঙ্গে যাবতীয় সামরিক সম্পর্ক ছিন্ন করে মলদ্বীপ যদি চিনকে জমি দেয় সামরিক ঘাঁটি বানানোর জন্য, তা হলে নয়াদিল্লির উদ্বেগ বাড়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। মোদী সরকারের বিদেশ নীতি নিয়েই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিল বিভিন্ন মহল।
মলদ্বীপে নির্বাচনটা হওয়ার পরেই পরিস্থিতি ফের বদলাতে শুরু করে। চিনের সমর্থন থাকলেও আন্তর্জাতিক মহলের সিংহ ভাগই প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের পদক্ষেপগুলির বিপক্ষে ছিল। প্রবল আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে দেশে নির্বাচন ঘোষণা করতে বাধ্য হন ইয়ামিন। সে নির্বাচনে তাঁর পরাজয় হয়। তার পরেও কারচুপির অভিযোগ তুলে ক্ষমতা ছাড়ার বিষয়ে টালবাহানা শুরু করেছিলেন চিনপন্থী প্রেসিডেন্ট। কিন্তু এক দিকে আন্তর্জাতিক চাপ, অন্য দিকে দেশের মধ্যে বাড়তে থাকা রোষ— দুইয়ের মাঝে পড়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করতে বাধ্য হয় ইয়ামিনের সরকার।
১৭ নভেম্বর যিনি শপথ নেবেন, সেই ইবু সোলিহ্ ফের ‘ভারতই প্রথম’ নীতিতে ফেরাবেন মলদ্বীপকে— দ্বীপরাষ্ট্রে গুঞ্জন এই রকমই। যে সব ভারতীয় প্রকল্পের কাজ আটকে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো ফের চালু করা হবে, ভারতীয় সংস্থাগুলোকে ফের মলদ্বীপে কাজ শুরু করতে দেওয়া হবে এবং ভারত-মলদ্বীপ সামরিক সম্পর্কও ফের মজবুত করা হবে— সোলিহ্ ইতিমধ্যেই তেমন ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সর্বোচ্চ স্তরের বিদেশি নেতা হিসেবে নরেন্দ্র মোদীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সোলিহ্ আরও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, মলদ্বীপকে ফের ভারতমুখীই করতে চলেছেন তিনি। ফলে গত প্রায় এক বছর ধরে চিনের দাপট যে ভাবে ক্রমশ বাড়তে দেখা যাচ্ছিল ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটিতে, তা আপাতত শেষ। জনমতে ভর করেই ফের ভারতের কাছাকাছি মলদ্বীপ।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক চুক্তি, আন্তর্জাতিক বিরোধ, আন্তর্জাতিক সংঘর্ষ- সব গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের আন্তর্জাতিক বিভাগে।