ভারতকে টপকে যাবে বাংলাদেশ?
জিডিপি বা মোট জাতীয় উত্পাদনে যত ফারাকই থাক, মাথাপিছু গড় আয়ে ভারতকে ছুঁয়ে ফেলব ফেলব করছে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, অনেকে পরিসংখ্যান বা স্ট্যাটিসটিকস দিয়ে বলছেন, বছর দুই-তিনেকের মধ্যে বাংলাদেশ ভারতের মাথা পিছু আয়কে ছাপিয়ে যাবে।
যে প্রতিবেশী দেশ থেকে ক্রমাগত লোক এই দেশে আসছেন জীবনে উন্নতির জন্য, জীবিকার জন্য, সেই বাংলাদেশ ‘মহা-ভারত’কে ডিঙ্গিয়ে যাবে ভাবলেই আমাদের জাতীয় গর্ব, একটু হলেও, খর্ব হয় বইকি। এ যেন বাংলাদেশের কাছে ক্রিকেট ম্যাচে নাস্তানাবুদ হওয়ার থেকেও লজ্জাজনক ব্যাপার! ভুল ভাববেন না। আমরা বাংলাদেশের উন্নতিকে হিংসা করি না। কিন্তু একটা অপেক্ষাকৃত তরুণ দেশ, দীর্ঘ সময় রাজনৈতিক অস্থিরতায় কাটানো একটা দেশ, কী করে মাথা পিছু আয়ের ক্ষেত্রে আমাদের মতন শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী দেশকে ছাপিয়ে যেতে পারে? সত্যিই কি তা সম্ভব? আসুন দেখা যাক।
বাংলাদেশের গতি
অর্থনৈতিক বৃদ্ধির নিরিখে বাংলাদেশ গত ক’বছরে বেশ ভাল ফল দেখিয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজন হওয়ার ফলে পূর্ব পাকিস্তান হয়। পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশগুলির মধ্যে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন নিয়ে নানা বিদ্বেষ ছিল। অনেক বছর ধরে তা চলতে থাকে। এর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়। আওয়ামি লিগের নেতৃত্বে এবং ভারতের সমর্থন পাওয়ার ফলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা যুদ্ধ জেতে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১২০ মার্কিন ডলার। এবং ভারতের তার থেকে ছিল খানিকটা বেশি, ১৪০ ডলার।
রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশকে নানান ভাবে পিছিয়ে নিয়ে যায় নানা সময়ে। একেই ছোট দেশ, তার পর সামরিক বিদ্রোহ এবং দ্রুত ক্ষমতার পরিবর্তন বাংলাদেশকে স্বাধীনতার প্রথম অনেকগুলো বছর বেশ ভুগিয়েছিল।
২০০৪ সাল থেকে অবশ্য অবস্থার পরিবর্তন আসে। “বাংলাদেশের অর্থনীতি মুলত রেডিমেড গার্মেন্টস বা পোশাকের রফতানি, এবং বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের পাঠানো টাকা (রেমিটেন্স) এই দুই খাতের উপর নির্ভরশীল। এর ওপর ইদানিংকালে যোগ হয়েছে ইনফ্রাস্টরাকচার বা পরিকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ”— বলছেন পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ প্রতিমরঞ্জন বসু। প্রতিমবাবুর কথায়, “অর্থনীতির সূত্র বলে যে, পরিকাঠামোতে যা বিনিয়োগ হয়, তার জিডিপি-র প্রবৃদ্ধির উপর একটা বড় রকমের প্রভাব থাকে। বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরে পরিকাঠামোর উন্নয়নমূলক কাজে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে এবং হচ্ছে। যেমন পদ্মার ব্রিজ, রেল পথ উন্নয়ন, নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র, নদী বন্দর ইত্যাদি। এর একটা প্রভাব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর থাকা উচিত।"
বাংলাদেশের মোট রফতানির ৮০ শতাংশের বেশি জোগায় বস্ত্রশিল্প। ২০১৬-১৭ সালে এই ক্ষেত্র ২৮ বিলিয়ন (২৮০০ কোটি) মার্কিন ডলার দেশকে দেয়। বাংলাদেশের জিডিপি-র অনেকটা আসে সার্ভিস সেক্টর থেকে। কৃষিও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ৫০ শতাংশ বাংলাদেশি কৃষির সঙ্গে নিযুক্ত। এই সব তথ্য জানাচ্ছে সিআইএ ফ্যাক্টবুক। ২০১২ থেকে ২০১৬-এর মধ্যে যে ভাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, সেটা দেখবার মতো। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের মাথা পিছু আয় ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে গড়ে বার্ষিক ৯.০৬ শতাংশ করে বেড়ে হয়েছে ১,৩৩০ মার্কিন ডলার। একই সময়ে ভারতের মাথাপিছু আয় ৩.০৭% বার্ষিক হারে বেড়ে হয়েছে ১,৬৭০ মার্কিন ডলার। ভবিষ্যতে একই হারে দু’দেশের বৃদ্ধি হতে থাকলে, বাংলাদেশ এবং ভারতের মাথাপিছু আয় ২০২০ সালে প্রায় সমান হবে, এবং ২০২১-এ বাংলাদেশ কিন্তু টপকে যাবে ভারতকে।
মজার ব্যাপার হল, ২০০৫ সালে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ভারত এবং বাংলাদেশের থেকে বেশি। ওই বছর পাকিস্তানের মাথা পিছু আয় ছিল ৭৩০ ডলার। ভারতের ছিল ৭০০ ডলার এবং বাংলাদেশের ছিল ৫৩০ ডলার। পরবর্তী দশ বছরে একটা বিশাল বদল হয়েছে। আজকে ভারত ১,৬৭০ ডলার, বাংলাদেশ ১,৩৩০ ডলার এবং পাকিস্তান ১,৫০০ ডলার। যদি সত্যি বাংলাদেশ ২০২০-২১ পর্যন্ত প্রতি বছর মাথাপিছু আয় ৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি ধরে রাখতে পারে, ভারত এবং পাকিস্তান যদি বর্তমান গতিতে থেকে যায়, তবে দুই দেশকেই টপকান সহজ হয়ে যাবে বাংলাদেশের।
‘ভারত ভাগ্য বিধাতা’ কোন পথে
যে সময় বাংলাদেশ ভাল ফল করেছে, ঠিক ওই সময়ে ভারতের অর্থনীতি নানান চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এর একটা বড় কারণ হল আমাদের অর্থনৈতিক সংস্কার। কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, দীর্ঘমেয়াদী এবং টেকসই উন্নয়নের জন্যই স্বল্পমেয়াদী বৃদ্ধি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার কিছুটা কমে গিয়েছে। এক সময় ভারত বছরে ৮ শতাংশ অর্থনৈতিক বৃদ্ধি দেখেছে। এখন সেই বৃদ্ধির হার কমে হয়েছে ৬-৭ শতাংশ। ঠিক এই সময় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গতি ঠিকঠাক রেখেছে এবং বৃদ্ধিতে গতি এনেছে। কিন্তু ভারতীয় অর্থনীতি যে আগামী ক’ছরে ধীর গতিতেই এগোবে, এ রকম মনে করে নেওয়ার কোনও কারণ নেই।
আরও পড়ুন: চিনকে পিছনে ফেলে বৃদ্ধিতে দ্রুততম ভারত
মে মাসের শেষ দিনে ভারত সরকার ঘোষণা করেছে যে— জানুয়ারি থেকে মার্চ ২০১৮ পর্বে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হয়েছে ৭.৭ শতাংশ। এর ফলে এপ্রিল ২০১৭ থেকে মার্চ ২০১৮ আর্থিক বছরে বৃদ্ধির হার হয়েছে ৬.৭ শতাংশ। একই সময়ে বাংলাদেশের জিডিপি বাড়বে ৭.৬-৭.৭ শতাংশ হারেই, এমন অনুমান করছেন অনেকে।
ভারতীয় অর্থনীতি মন্থরতা কাটিয়ে উঠছে। জিএসটি এবং মুদ্রারহিতকরণের (ডিমনিটাইজেশন) শক থেরাপির পর আর্থিক অবস্থা ঠিক হচ্ছে। এক বছরের পর ভারতের বৃদ্ধির হার বেড়ে দাঁড়াবে ৭.৫ শতাংশে (এপ্রিল ২০১৮ থেকে মার্চ ২০১৯ আর্থিক বছরে), এমন বলা হচ্ছে। আগামী সাত-আট বছরে ভারতকে ৫ ট্রিলিয়ন (পাঁচ লক্ষ কোটি) মার্কিন ডলারের অর্থনীতির দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য সরকার একটি উচ্চ পর্যায়ের টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে। যদি ভারত ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হয়, মাথা পিছু আয় অনেক বেড়ে যাবে। তা হলে, শুধু বাংলাদেশের মতো দেশকে পিছনে ফেলে রাখাই নয়, অনেক বাঘা বাঘা দেশকে ভারত ছাপিয়ে যাবে।
ভারতের জন্যে ২০১৮-১৯ বছরটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। "২০১৮-১৯ সালে আর্থিক বৃদ্ধি চালিত হবে সরকারি খরচ এবং তার মাল্টিপ্লায়ার এফেক্ট-এর জন্যে"— বলছেন এমকে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস-এর ধনঞ্জয় সিনহা, যিনি প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার কাজ করেন।
আরও পড়ুন: মেয়েরা কাজে এলে জিডিপি বাড়বে ২৭%
যদিও তেলের দাম বাড়ার একটা খারাপ প্রভাব মূল্যবৃদ্ধির উপর আসতে পারে, অনুমান করা হচ্ছে যে তেলের দাম প্রচণ্ড বেশি হবে না। কয়েক বছর ভারতের একটু খারাপ গিয়েছে বলে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই যে আমাদের অর্থনীতির সুসময় শেষ। বাংলাদেশ, ঠিক ভারতের মতই, বিদেশে মাল রফতানি করে একটা বড় অংশ আয় করে। বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ একমত যে, ভারতের জিডিপি-র চিত্তাকর্ষক বৃদ্ধির জন্য একটি স্পন্দনশীল উত্পাদন সিস্টেম প্রয়োজন। শুধু এক্সপোর্ট নয়, সঙ্গে চাই দেশের মধ্যে মালের চাহিদা (ডোমেস্টিক কন্সাম্পশান)।
বর্তমানে 'ম্যানুফ্যাকচারিং' একটু ধিমে চালে চললেও, ভারত সরকার ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করার জন্যে নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাধা অপসারণ করেছে। ভারতকে উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিজের সংস্থাদের এক্সপোর্টের জন্যে অনেক বেশি উৎসাহ দিয়ে হবে।
বিশেষ ফোকাস চাই ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের ক্ষেত্রে। এরা আমাদের দেশের শিল্প কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ গঠন করে। বিনিয়োগকারীদের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘমেয়াদী নীতি দরকার। কিছু কাজ ইতিমধ্যেই হচ্ছে।
এ ছাড়া, দক্ষ শ্রমশক্তির বিকাশের জন্য শিল্প কারিগরি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলি অবশ্যই প্রধান উৎপাদন কেন্দ্রগুলির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
সব কিছু ঠিক করে হলে, মনে হয় না ভারতের অর্থনৈতিক হাল খুব খারাপ হবে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত কিছুটা সময় মন্দা থাকলেও, সামনের কটা বছরে অর্থনৈতিক শক্তি ফিরবে, এমটা মনে করছেন অনেকেই।