কয়েক দিন আগের কথা। আফগানিস্তানে দোষীদের কী রকম শাস্তি দেওয়া হবে, তার বর্ণনা দিয়েছিলেন এক তালিবান নেতা। সেই বর্ণনা শুনে বিশ্বের তথাকথিত সভ্য দেশগুলির নাগরিকদের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। তালিবান ওই নেতা জানিয়েছিলেন, ‘অল্প’ অপরাধের শাস্তি দিতে হলে অপরাধীর হাত-পা কেটে নেওয়াটা জরুরি। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে এমন শাস্তি হওয়া দরকার। এর আগে তালিব জমানায় অপরাধীদের মাথা কেটে শাস্তি দেওয়ার ছবি প্রকাশ্যে এসেছে। আতঙ্কের কারণ তার স্মৃতি। যদিও ইতিহাস বলছে, শাস্তি কতটা নৃশংস আর যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে, তা গোটা বিশ্বকে এক সময় দেখিয়ে দিয়েছিল ইউরোপ।
সম্প্রতি বিশেষজ্ঞরা তার আরও একটি প্রমাণ পেয়েছেন। ইতালির মিলানের একটি গির্জার কাছে খননকাজ চালাচ্ছিলেন কিছু প্রত্নতত্ত্ববিদ। খোঁড়াখুঁড়ির সময়ে একটি কঙ্কাল পাওয়া যায়। কঙ্কালটি পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বিশ্বের অন্যতম নৃশংস শাস্তির শিকার হয়েছিলেন মানুষটি।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, কঙ্কালটি ১৭-২০ বছর বয়সি এক তরুণের। চেহারায় বেঁটে-খাটো মানুষটির মৃত্যুর সময় দাঁত-কপাটি লেগে গিয়েছিল। মুখের প্রায় সবক’টি হাড় স্থানচ্যুত হয়েছিল। এমন হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, অসহ্য যন্ত্রণায় এমন হতে পারে। কারণ ওই ব্যক্তি বিশ্বের অন্যতম যন্ত্রণাদায়ক ‘চাকায় শাস্তি’র শিকার হয়েছিলেন। ঘৃণ্য অপরাধের জন্য একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে ইউরোপে এই শাস্তির প্রচলন ছিল।
কী ভাবে শাস্তি দেওয়া হত? বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রথমে অপরাধীদের হাত-পা বেঁধে দেওয়া হত। তারপর একটি ভারী চাকা (মূলত গরু বা ঘোড়ায় টানা গাড়ির চাকা, যা কাঠ দিয়ে তৈরি এবং লোহার বেড় দিয়ে মোড়া) বেশ খানিকটা উপর থেকে ফেলা হত অপরাধীর পায়ের পাতা আর হাঁটুর মাঝামাঝি অংশে। এক আঘাতেই হাড় ভেঙে যাবে— এমন ভাবে।
তার পর শরীরের কিছুটা উপরের অংশ এবং ধীরে ধীরে আরও উপরে একই ভাবে এবং আরও বেশি উচ্চতা থেকে অবিরাম ফেলা হত চাকাটি।
কতবার এক জনের শরীরে এই ভাবে চাকা ফেলা হবে, সেই সিদ্ধান্ত নিত আদালত। অপরাধের ধরন দেখে ঠিক করা হত, চাকায় ধারালো কিছু আটকে দেওয়া হবে কি না।
শাস্তি তবু শেষ হত না। অপরাধীকে ওই চাকাতেই বেঁধে ধারালো বা ভোঁতা কিছু দিয়ে আঘাত করা হত এর পর। আরও যন্ত্রণা দিতে অনেক সময় লোহার গরম শলাকাও ব্যবহার করা হত। তার পর একটি খুঁটিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হত চাকাটি। সাধারণ মানুষ যাতে বুঝতে পারেন, অপরাধের পরিণাম কী হতে পারে।
অপরাধীকে চাকায় বেঁধে চাকাটি গড়িয়ে দেওয়াও হত। কখনও পাহাড়ি রাস্তায়, কখনও কাঁটা বিছনো রাস্তায়। কোথাও আবার চাকায় বেঁধে চাকাটিকে ঝুলিয়ে দেওয়া হত জ্বলন্ত আগুনের উপর। ইউরোপের নানা দেশের বিভিন্ন শহরের প্রশাসন নিজেদের মতো করে বদলে নিয়েছিল চাকার শাস্তিকে।
এই ধরনের শাস্তি যাঁদের দেওয়া হত, অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা জখম হয়েও বেশ কিছু দিন জীবিত থাকতেন। কিছু ক্ষেত্রে আবার তাঁদের বলবর্ধক পানীয় খাইয়ে জোর করে বাঁচিয়ে রাখা হত।
ইতিহাসবিদরা জানিয়েছেন, চতুর্দশ শতাব্দীর খুনের এক অপরাধী এ ভাবে তিন দিন জীবিত ছিলেন। জার্মানির এক হত্যাকারীকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল ন’দিন।
কিছুটা ‘ভাগ্যবান’ যাঁরা, তাঁদের মাথায় চাকা দিয়ে আঘাত করা হত প্রথমেই। ফলে তাঁরা কিছুটা কম যন্ত্রণা সহ্য করে সঙ্গে মারা যেতেন। তবে শাস্তি দেওয়ার সময় চাকাটি ভেঙে গেলে বা অপরাধী কোনও ভাবে বেঁচে গেলে ঘটনাটিকে ‘ঈশ্বরের ইচ্ছে’ ধরে নেওয়া হত। সে ক্ষেত্রে দোষী বিনা শাস্তিতে মুক্তি পেতেন।
দুর্ভাগ্যবশত মিলানে উদ্ধার তরুণ অপরাধীর ক্ষেত্রে তেমন কিছু হয়নি। উল্টে প্রত্নতত্ত্ববিদদের দাবি, সম্ভবত চাকায় বাঁধা অবস্থায় তাঁর মাথা কাটার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বদলে মাথায় গুরুতর আঘাত পান ওই তরুণ। কঙ্কালটির খুলিতে সেই আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট।
তাঁর অপরাধ কী ছিল, তা এখন আর জানা সম্ভব নয়। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদরা অনেক দেখে শুনে বিচার করে একটি সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, ওই তরুণ সম্ভবত আকার আকৃতিতে তাঁর সমকালীনদের তুলনায় কিছুটা ‘অন্য রকম’ ছিলেন। তাঁর শারীরিক গঠনও ‘অন্য রকম’ ছিল। এমনও হতে পারে এই ‘আলাদা’ হওয়ার কারণেই প্রশাসনের বিষ নজরে পড়েন তিনি।
চতুর্দশ শতাব্দীতে মহামারি ছড়ানোকেও বড় অপরাধ বলে গণ্য করা হত। ইতিহাসবিদরা বলছেন, এমনও হতে পারে ওই ব্যক্তিকে প্লেগ ছড়াচ্ছেন বলে দোষীসাব্যস্ত করে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।