আড়ালে থেকেই বিদায় হিমলার-কন্যার

‘নাৎসি-রাজকন্যা’ হিসেবে পরিচিত সেই গুডরুন বুরউইৎজ় মারা গেলেন ৮৮ বছর বয়সে। ২৪ মে। কিন্তু সেই ‘নিশ্চিত মৃত্যুসংবাদ’ গোটা দুনিয়ার কাছে পৌঁছতে লেগে গেল প্রায় গোটা একটা মাস।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

ওয়াশিংটন শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৮ ০৩:৪৭
Share:

তখন: বাবা হিমলারের সঙ্গে খুদে গুডরুন।

তাঁর বাবা ছিলেন অ্যাডলফ হিটলারের ডান হাত। হলোকস্টের অন্যতম মস্তিষ্ক। নাৎসি প্রশাসনের দ্বিতীয় শীর্ষ কর্তা— হাইনরিখ হিমলার। আর তাঁকে হিটলার নিজে এক বড়াদিনের পার্টিতে পুতুল আর চকোলেট উপহার দিয়েছিলেন। ‘নাৎসি-রাজকন্যা’ হিসেবে পরিচিত সেই গুডরুন বুরউইৎজ় মারা গেলেন ৮৮ বছর বয়সে। ২৪ মে। কিন্তু সেই ‘নিশ্চিত মৃত্যুসংবাদ’ গোটা দুনিয়ার কাছে পৌঁছতে লেগে গেল প্রায় গোটা একটা মাস।

Advertisement

খবরটা প্রথম বেরোয় এক জার্মান সংবাদপত্রে। ওখানেই বলা হয়, ছয়ের দশকের প্রথম দিকে গুডরুন পশ্চিম জার্মানির বিদেশি গুপ্তচর সংস্থার হয়ে কাজ করতেন। তাঁর মৃত্যুর খবর নিয়ে রাখঢাকের সেটাও একটা কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।

‘নাৎসি রাজকন্যা’ তখন বছর বারো। বাবার হাত ধরেই কুখ্যাত ডাখাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে ডায়েরিতে লিখলেন— ‘‘এক কথায় দারুণ কাটল গোটা দিনটা। বাগান দেখলাম, প্রচুর গাছপালা। বন্দিরা কী সুন্দর সব ছবি এঁকেছে! আর সব শেষে খাওয়াটাও জব্বর হয়েছিল। ফাটাফাটি।’’ বাবা হিমলারের মতো তাঁকেও আজীবন নাৎসি-সমর্থক বলে মনে করা হয়। দু’জনেই মনে করতেন, নাৎসিরা কোনও ভুল করেনি। করতে পারে না। তাই ইতিহাসের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। গুডরুন তো আবার ‘হলোকস্ট’ হয়েছিল বলেই মানতে চাননি কখনও। বরং শেষ দিকে দোষী সাব্যস্ত এবং যুদ্ধ অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত নাৎসিদের তিনি বিস্তর অর্থসাহায্যও করেছিলেন বলে জানা যায়।

Advertisement

গুডরুনের জন্ম ১৯২৯-এ। বাবা, হিমলার তখন হিটলারের সঙ্গে শীর্ষে ওঠার মই বাইছেন। ততক্ষণে নাৎসিদের প্যারামিলিটারি বাহিনীর (এসএস) নেতাও হয়ে গিয়েছেন। শোনা যায়, গুডরুন প্রথম থেকেই বাবার সব চেয়ে প্রিয় সন্তান ছিলেন। সে ভাবে তৈরিও হচ্ছিলেন। তিরিশ-চল্লিশের দশকে প্রায়শই বাবার সঙ্গে ছবি বেরোত তাঁর। দিব্যি হাশিখুশি, বাপসোহাগী। নিজেই ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘‘বাবার চকচকে পালিশ করা জুতোয় আমি আমার প্রতিচ্ছবি দেখতে চাই। সব সময়ে।’’

তবু ‘দুঃসময়’ এল নিজের নিয়মেই। ১৯৪৫-এর মে। জার্মানির কাছে যুদ্ধে হারল নাৎসি বাহিনী। গুডরুনের বয়স তখন ১৫। মায়ের সঙ্গে দেশ ছেড়ে পালালেন উত্তর ইতালিতে। কিন্তু ধরাও পড়ে গেলেন মার্কিন সেনার হাতে। বাবা হিমলারও ধরা পড়লেন অন্যত্র। রুশ সেনার হাতে। তাঁকে পাঠানো হল ব্রিটিশ হেফাজতে। সেখানেই পটাশিয়াম সায়ানাই়ডের ক্যাপসুল কামড়ে মরলেন হিমলার। মেয়ে অবশ্য বাবার এই আত্মহত্যার তত্ত্ব কখনও মানতে চাননি।

গুডরুন আর তাঁর মাকে চার বছর ইতালি, ফ্রান্স এবং জার্মানির বিভিন্ন জায়গায় বন্দি হিসেবে রাখা হয়। পরে হিমলারের একাধিক যুদ্ধ-অপরাধ মামলার শুনানিতে ডেকে পাঠানো হয় মেয়েকে। শোনা যায়, চরম সেই দুর্দশার দিনগুলোয় কাঁদতেন না গুডরুন। শুধু থেকে থেকেই অনশনে চলে যেতেন। ‘রুগ্‌ণ রাজকন্যাকে’ যার ফল ভুগতে হয়েছিল বন্দিদশা কাটিয়েও।

স্বাভাবিক জীবনে ফিরে মা-মেয়ে স্থায়ী হন উত্তর জার্মানির এক শহরে। পেট চালাতে জামাকাপড় সেলাই এবং বই-বাঁধাইয়ের কাজ শেখেন হিমলার-কন্যা। কিন্তু পারিবারিক ইতিহাসটাই যেন তিষ্ঠোতে দিচ্ছিল না তাঁকে। পাকা চাকরি কই!

১৯৬১-তে যা-ও বা গুপ্তচর সংস্থায় কাজ পেলেন, বছর দুয়েকের মধ্যে সেটাও গেল। ওই দশকেরই শেষে খ্যাতনামা লেখক উলফ দিয়েতর বুরউইৎজ়কে কে বিয়ে করে তিনি মিউনিখে চলে আসেন। দু’টি সন্তানও হয় তাঁদের।

গুডরুনকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমের আগ্রহের শেষ ছিল না, কিন্তু তিনি থেকে গেলেন মুখে কুলুপ এঁটেই। অথচ শোনা যায়, ২০১৪-য় লুকিয়ে থাকা এসএস-অফিসারদের অস্ট্রিয়ার পুনর্মিলনেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি। তবে সেই শেষ।

২০১৫-য় এক ব্রিটিশ সাংবাদিক তাঁর বাড়ি বয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। মুখের উপর দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ও-পার থেকে শোনা গিয়েছিল— ‘‘আপনাদের কাউকে চাই না। কেউ যেন আর না আসে এখানে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement