নোবেল জয়ের খবর শোনার পরে প্যারিসে সাংবাদিক বৈঠকে পাত্রিক মোদিয়ানো। ছবি: রয়টার্স।
তাঁর এক একটি বই পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে। তারা যেন একে অপরের প্রতিধ্বনি। এ বছরের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পরে ফরাসি লেখক পাত্রিক মোদিয়ানোকে এ ভাবেই চিনিয়ে দিলেন সুইডিশ অ্যাকাডেমির সচিব পিটার ইংলান্ড। ফ্রান্সে পাত্রিকের নাম সুবিদিত। বেশ কিছু কাজ অনূদিত হয়েছে ইংরেজি-সহ বিভিন্ন ইউরোপীও ভাষায়। তবে বাকি দুনিয়া এখনও সে ভাবে চেনেনি তাঁকে। স্মৃতি আর সত্তা তাঁর কাজে ফিরে ফিরে আসে। ইহুদিদের যন্ত্রণা, নাৎসি আগ্রাসন এবং হারানো সত্তার গল্প বলেন তিনি। তিনি এ যুগের ‘মার্সেল প্রুস্ত’ সমসময়ের ফরাসি ঔপন্যাসিককে এই আখ্যা দিয়েছেন পিটার।
সাহিত্যে নোবেলের ১০৭তম প্রাপক পাত্রিক তাঁর দেশের একাদশতম লেখক, যিনি এই সম্মান পেলেন। কেনিয়ার গুগি ওয়া থিয়োঙ্গো, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জাপানি ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামি বা আমেরিকার ফিলিপ রথ সাহিত্যে সম্ভাব্য নোবেল-প্রাপকের তালিকায় ঘোরাফেরা করছিল এই নামগুলোই। তালিকায় অনেক নীচের দিকে ছিলেন পাত্রিক। নোবেল অ্যাকাডেমির ভাষায়, “মোদিয়ানো পুরস্কৃত হচ্ছেন স্মৃতির সেই সৌকর্যের জন্য, যার সাহায্যে তিনি অনায়াসে ছুঁয়ে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা মানবনিয়তি। খুঁজে পান আগ্রাসনের মধ্যে দৈনন্দিন বেঁচে থাকার ছবি।”
মোদিয়ানোর সব চেয়ে পরিচিত উপন্যাসটির নাম ‘মিসিং পার্সন’ (১৯৭৮)। যাতে রয়েছে স্মৃতি হারানো এক গোয়েন্দার স্মৃতি-সন্ধানের গল্প। ওই গোয়েন্দাকে যে অন্তিম রহস্যের সমাধানে নামতে হয়েছিল, তাতে নিজেকে খুঁজে বার করাটাই ছিল তাঁর চ্যালেঞ্জ। ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে হাঁটা। যেন ফেলে আসা নিজেরই পায়ের ছাপ উদ্ধারের চেষ্টা। নোবেল অ্যাকাডেমির সচিবের কথায়, “১৩০-১৫০ পাতার ছোট ছোট বই। কখনও স্মৃতি হারানো, কখনও সত্তা, কখনও খোঁজার গল্প।” ফ্রান্সে নাৎসি আগ্রাসনের যন্ত্রণাদায়ক এবং লজ্জাকর অধ্যায় নিয়ে অসম্ভব একাগ্র মোদিয়ানো। নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন সে কথা। “প্রত্যেকটি উপন্যাস শেষ করার পরে মনে হয়, সব বলে দিয়েছি। কিন্তু জানি আমায় বারবার ফিরে আসতেই হবে। সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্মৃতির কাছে। সেই টুকরোগুলো আমারই অংশ। যে সময়ে আমরা জন্মেছি, যেখানে আমরা জন্মেছি সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে।” আর তাই তিনি লিখে যান প্যারিসের কথা। শহরটির পথঘাট-চরিত্র-মানুষ কী ভাবে পাল্টে যাচ্ছে, লেখনী ধরেন তাই নিয়ে।
১৯৪৫-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার দু’মাস পরে পশ্চিম প্যারিসের শহরতলিতে জন্ম মোদিয়ানোর। বাবা ইতালীয় বংশোদ্ভূত ইহুদি। নাৎসি আগ্রাসনে প্যারিস যখন ধুঁকছে, সেই সময়েই মোদিয়ানোর বেলজিয়ান অভিনেত্রী মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর বাবার। জন্মের পরে বাবাকে খুব বেশি দেখতে পাননি মোদিয়ানো। ওই ব্যক্তি অসামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়েছিলেন, এমন অভিযোগও শোনা গিয়েছিল। টালমাটাল সময়ে জন্মানো মোদিয়ানো সেই শৈশবের দিনগুলো বারবার তুলে আনেন তাঁর সৃষ্টিতে। ১৯৬৮ সালে, ২৩ বছর বয়সে লেখেন প্রথম উপন্যাস ‘লা প্লাস দ্য লেতোয়াই’। প্যারিসের অন্যতম ব্যস্ত বারোটি রাস্তার সংযোগস্থলের নামে নামকরণ উপন্যাসের। তবে প্রথম জীবনের লেখাগুলো তাঁকে আর ছুঁয়ে যায় না, এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন মোদিয়ানো। বলেছিলেন, “অল্প বয়সের লেখাগুলো আর পড়তে ইচ্ছে করে না। আমার ওগুলো পছন্দ হয় না, তা নয়। কিন্তু আমি ওগুলোর মধ্যে নিজেকে আর খুঁজে পাই না।”
তাঁর প্রথম উপন্যাসে শহরের মানচিত্রকে নাৎসি-আগ্রাসনের পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছেন মোদিয়ানো। জার্মানিতে বিশেষ সমাদৃত এই উপন্যাসটিই তাঁকে খ্যাতির দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। অনেক বছর পরে, ২০১১-এ লেখা ‘লরাইজন’ উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট আর একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত শহর বার্লিন। মোদিয়ানোর কথায়, “আধুনিক শহরগুলোর কংক্রিটের তলায় যে যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ পড়ে রয়েছে, সেখানেই লুকনো আমাদের প্রজন্মের শিকড়।” উপন্যাস ছাড়াও নাটক লিখেছেন পাত্রিক। কলম ধরেছেন ছোটদের জন্যও। ২০০০ সালে কান ফিল্মোৎসবে বিচারকের ভূমিকাতেও দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
অধুনা প্যারিসের বাসিন্দা, ৬৯ ছোঁয়া লেখক, কিন্তু সংবাদমাধ্যম থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেই পছন্দ করেন। তিনি সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছেন এমন ঘটনা বিরল। বছর তিনেক আগে সেই বিরল ক্ষেত্র থেকে যে দু’একটা কথা শোনা গিয়েছিল তাঁর মুখে: “কোনও দিন অন্য কিছু করার কথা ভাবিইনি। আমার না ছিল ডিপ্লোমা। না ছিল কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্য। কিন্তু অত কম বয়সে লেখক হয়ে ওঠাও তো কঠিন কাজ!”