ছবি: সংগৃহীত।
বাড়ি-বাড়ি গিয়ে তল্লাশি করা হয়েছিল, প্রতিটি পরিবারে খুঁজে দেখা হয়েছিল... কেউ কী এমন আছেন। আর তার পর, ১৩ হাজার মানুষকে এক জায়গায় জড়ো করা হয়েছিল। তাঁদের সকলের একটাই পরিচয়। তাঁরা ইহুদি। ১৯৪২ সালের ১৬ ও ১৭ জুলাই হিটলারের নির্দেশে এই ১৩ হাজার ইহুদিকে নাৎসি ক্যাম্পে পাঠিয়েছিল ফরাসি পুলিশ। সেই ঘটনার পরে আশিটা বছর কেটে গিয়েছে। নাৎসি অত্যাচারের শিকার সেই মানুষগুলোর স্মৃতিতে আজ শ্রদ্ধা জানাল ফ্রান্স।
হিটলারের জমানা দেখে এসেছেন, নাৎসি অত্যাচারের হাত থেকে বেঁচে ফিরেছেন, এমন মানুষের সংখ্যা সময়ের ফেরে ক্রমশ কমছে দেশে। ফ্রান্সের আশঙ্কা, ইহুদি বিদ্বেষ ফের একটু একটু করে মাথাচাড়া দিচ্ছে। হলোকস্টে ফ্রান্সের ভূমিকার উপরে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করছে দক্ষিণপন্থীরা। এ দেশে অনেকেরই তাই ভয়, ক্রমে না ইতিহাসের সেই ক্ষত ভুলে যায় মানুষ।
১৯৪২ সালের সেই ঘটনার আশি বছর পূর্তিতে এক সপ্তাহব্যাপী স্মৃতিচারণা হয়েছে। আজ ছিল শেষ দিনের আয়োজন। উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ। তাঁর মুখেও উঠে আসে অতীতের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে ফ্রান্সের অন্যতমলজ্জাজনক ঘটনা। অন্ধকারতম সময়। দু’দিনে ১৩,১৫২ জনকে ‘শিকার’ করে পুলিশ। তার মধ্যে ৪১১৫টি বাচ্চা ছিল। তাদের নিয়ে আসা হয় প্যারিসের উইন্টার ভেলোড্রোমে। তার পর সেখান থেকে পাঠানো হয় নাৎসি ক্যাম্পে। সমস্ত বাচ্চাকে তাদের পরিবার থেকে আলাদা করেদেওয়া হয়েছিল। খুব অল্প সংখ্যকই বেঁচে ফিরেছিল।
এমনই এক জন রেচেল জেডিন্যাক। আশি বছর আগের স্মৃতি তাঁর মনে এখনও যেন দগদগে ঘায়ের মতো। জানালেন, রাতের অন্ধকারে পুলিশ এসে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে। তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ি থেকে। প্যারিসের রাস্তায় পুলিশের ঢল। বন্দিদের টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ভেলোড্রোমে। সে দিনও তার চোখে পড়েছিল আইফেল টাওয়ার। তার নীচে যেন ঘন অন্ধকার।
রেচেলের মনে আছে, তাঁর মা পুলিশকে লক্ষ্য করে পাগলের মতো চিৎকার করে যাচ্ছিলেন। বাঁচার শেষ চেষ্টা। কিছু পড়শি খবর দিয়েছিল, এই বাড়িতে ইহুদিরা থাকে। আবার পড়শিদের অনেককে কাঁদতেও দেখেছিলেন রেচেল। গরুবাছুরের মতো তাঁদের টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
আজকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শঁতাল ব্লাৎস্কা। তাঁর তিন আত্মীয়ের নাম খোদাই করা রয়েছে স্মৃতিসৌধে। ৬ বছরের সিমোন, ৯ বছরের বার্থ ও ১৫ বছরের সুজ়ান। আরও এমন চার হাজার বাচ্চার নাম খোদাই করা ওইসৌধে। যেখানে ভেলোড্রোম ছিল, সেখানেই পরবর্তী কালে স্মৃতিসৌধটি তৈরি হয়। আজ সেই বাগানটিকে সাজানো হয়েছিল নাৎসি অত্যাচারের শিকার সেই সব শিশু-কিশোর-কিশোরীর ছবি দিয়ে।
সার্জ ক্লার্সফেল্ডের বাবা ছিলেন আউশভিৎস ক্যাম্পে। সে দিনের আতঙ্ক আজও বেঁচে আছে তাঁর মনে। বললেন, ‘‘যে স্মৃতি রয়েছে, তা বাঁচিয়ে রাখা জরুরি।আমাদের মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট, তারও ৮০ বছর বয়স হল। এই ক্ষত ভুলে গেলে চলবে না।’’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৫০ বছর পরে ফ্রান্স সরকারি ভাবে স্বীকার করেছিল, তাদের অন্যায়ের কথা, হলোকস্টে ফ্রান্সের জড়িত থাকার কথা। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জাক চিরাক প্রথম ক্ষমা চান। অনেকেরই দাবি, ফের ইহুদিদের উপর অত্যাচারের ইতিহাস অস্বীকার করতে শুরু করেছে একদল দক্ষিণপন্থী। ইতিহাসে মিথ্যার আস্তরণ ফেলার চেষ্টা করছে তারা। যার স্পষ্ট নিদর্শন মিলেছেএ বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দক্ষিণপন্থীদের প্রচারে।