আমরা মজা করে তার নাম দিয়েছিলাম ‘দুঃখের বাড়ি’!
বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেল চিরতরে, বড্ড অকালে। আর অমনি আমাদের ‘চাঁদের বাড়ি’টা হঠাৎ মাচা সরিয়ে নেওয়া লতানে গাছের মতো মাটিতে গুটিয়ে পড়ল। আমাদের তিন ভাইবোনকে নিয়ে শুরু হল আমার সহায়-সম্বলহীন শিক্ষয়িত্রী মায়ের বেঁচে থাকার তীব্র লড়াই। আমরা তখন অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে একটা বাড়ি। কিন্তু সে তো বাহিরে, অন্তরে তার ছিল অপূর্ব এক আনন্দধারা। নির্ভীক লড়াইয়ের মধ্যে তো একটা আনন্দ থাকে। সেটা ওই বাড়িটায় ছিল। আমরা মজা করে তার নাম দিয়েছিলাম ‘দুঃখের বাড়ি’!
শত দারিদ্র, শত অপমানের সেই দিনগুলিতে, রাতের বেলায় মা আমাদের একরত্তি তিন ভাইবোনকে অনেক অনেক আলো-আঁধারের গল্প বলে ঘুম পাড়াত। মা বলত, ‘ঘুমিয়ে পড় সোনারা, ঘুমোলেই দেখবি স্বপ্ন আসবে। আর সেই স্বপ্নের মাঝে তোরা স্পষ্ট দেখতে পাবি, এই বাড়িটার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে নানা রংয়ের ফুলের পাপড়ি’। আর তারই মাঝে আমাদের বাবা ‘কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ণ’ রেখে গেছে, এটা আমি আমার কিশোরবেলা অবধি বিশ্বাস করতাম। আসলে কেউ যখন অনেক দূরে চলে যায়, সে তার ‘কাছের পৃথিবী’-তে একটা চিহ্ন রেখে যায়। আমার উদ্বাস্তু চিরলড়াকু বাবা আমাদের কাছে একটা লড়াইয়ের অভিজ্ঞান রেখে গেছিল। মা বলত, ‘ওটাই তোমাদের উত্তরাধিকার’।
ওই লড়াইটা ছিল আমাদের ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’, দীপাবলির রাতের মতো। এ ছাড়া আর তো কিছুই ছিল না আমাদের। ছিল শুধু সযতনে আড়ালে রাখা একটা খাঁ খাঁ শূন্যতা। আসলে কোনও প্রিয় মানুষ কাউকে কিচ্ছুটি না বলে আচমকা চলে গেলে, বুকের ভিতর একটা নীরব শূন্যতা জন্ম নেয়। দার্শনিকরা সেটাকেই মৃত্যু বলে ব্যাখ্যা করেন, বর্ণনা করেন স্মৃতি বলে। আমরা তিন ভাইবোন তখন এইটুকুনি। কাজেই এ সব বোঝার বয়স তখন আমাদের হয়নি। এ সব আমি বুঝেছিলাম অনেক পরে, কৈশোরের এক দীপাবলির রাতে।
কালীপুজোর বিকেলে পাশের বাড়ির বাবন আর ওর বোন রীতার সঙ্গে খেলছিলাম আমরা তিন ভাইবোন, ওদের বাড়িতে। সন্ধ্যা হল। ওদের বাবা কপিলকাকু বাড়ি ফিরলেন অজস্র মোমবাতি আর আলোর ম্যাজিকের মতো সব আতসবাজি নিয়ে। বাবন আর রীতা হইহই করে ওদের বাড়ির ছাদে চলে গেল, মোমবাতি জ্বালাতে আর বাজি ফোটাতে। আমরা অনাহুতের মতো বেরিয়ে এলাম ওদের বাড়ি থেকে। আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখলাম বাবনদের বাড়ির ছাদের দীপাবলি, ঠিক যেমন করে কৈশোরের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ‘ভিখারির মতন’ দেখেছিলেন চৌধুরীদের বাড়ির রাস উৎসব, ‘অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা কত রকম আমোদে হেসেছে, আমার দিকে ফিরেও চায়নি’!
চারিদিকে ঢাক বাজছে, বাজি ফাটছে, বারুদে ধোঁয়ায় চোখ জ্বলছে আমাদের, শ্যামাপুজোর সান্ধ্যশিশির হিম ধরিয়ে দিচ্ছে আমাদের বুকে। আলোর মধ্যেও যে অন্ধকারের মতো একটা নিকষ কালো ‘মন খারাপ’ থাকে, দীপাবলির মাঝেও যে লুকিয়ে থাকে দুঃখ, সেই প্রথম আমি সেটা জানতে পারলাম। আর ভিজে যাওয়া দু’চোখে টের পেলাম, আমাদের বাবা নেই। কোত্থাও নেই। বাড়ি ফিরলাম। আলোকের এই আনন্দধারায় যেন একলাটি দাঁড়িয়ে আছে একটা ‘দুঃখের বাড়ি’। আর তারই এক বিজন গৃহকোণে মা আমার বাবার ছবির সামনে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে গান গাইছে, ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই, কোথাও দুঃখ কোথাও মৃত্যু কোথা বিচ্ছেদ নাই’। আমার সব কিছু আবছা লাগছে, দেখতে পাচ্ছি না কিছু। কিন্তু এ যে এক অসম্পূর্ণ ভালবাসার দৃশ্য, আমাকে তো দেখতেই হবে। ‘অন্তরে আজ দেখব যখন আলোকে নাহি রে’। দেখলাম, নয়নভরে। আর বুঝতে পারলাম, আমার দীপাবলির সঙ্গে মিশে আছে একান্ত সেই আলো-আঁধারের গল্প।
আমার আরও একটা গল্প আছে দীপাবলির, আলো-আঁধারের। দীপাবলির সেই সন্ধ্যায় আমার সে দিন। সিগারেটে কয়েকটা টান দেওয়ার পরে মাথাটা কেমন ঘুরছিল, বমি পাচ্ছিল। খানিক ঘোরের মধ্যে ছাদের কার্নিশে বসে পড়লাম আমি। দেখলাম, গৌতমদের বাড়ির ছাদে আকাশপ্রদীপ জ্বলছে, ‘দূরের তারার পানে চেয়ে’। আমার মা বলত, ‘কাছের কেউ চলে গেলে, সে ওই দূর আকাশে তারা হয়ে থাকে। প্রতিরাতে সে চুপটি করে দেখে কাছের মানুষদের।’ আমার বাবা বুঝি এমনি এক ভিনদেশি তারা, ‘তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে, আরো দূরে!’ মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঠিক আমার বাবার মতো আমিও কাওকে কিচ্ছুটি না বলে বেরিয়ে এলাম গৌতমদের বাড়ি থেকে। আমি জানি, একটু পরে প্রসূন যাবে একটু দূরেই রাজশ্রীদের বাড়ি। গৌতমও হানা দেবে এন এস রোডে ভাস্বতীদের বাড়ি।
আমি কোথায় যাব? আমি বরং একলাটি হাঁটি অনিশ্চিত। যাওয়ার পথে কি কড়া নাড়ব একবার প্রিয় সখী ঝুম্পার বাড়িতে? না, আজ থাক। চারিদিকে আলোর মালা, বাজি-পোড়ানো ফসফরাসের গন্ধ। চোখ জ্বালা করছে আমার, আলোগুলো ঝাপসা লাগছে। আজ ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন, আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন!’ আমি চললাম একাকী। বাঁধ রোডের দিকে। ওখানে নিশ্চিত দেখা হবে অর্ঘ্য, সোম, স্নেহাংশু আর অভিজিতের সাথে। মনামির বাড়ির প্রায় লাগোয়া আই এম এ বিল্ডিংয়ের রকে বসে মিঠে গলায় অভিজিত ‘কভি কভি মেরা দিল মে খ্যায়াল আতা হ্যায়’ গাইবে! তবু মনামিদের বাড়ির দরজা খুলবে না। অগত্যা স্নেহাংশু হাঁটা দেবে রুম্পার বাড়ির দিকে, যদি ক্ষণিকের দেখা মেলে। সোম হনহনিয়ে পায়চারি করবে মকদমপুরের একটা গলির রাস্তায়, একটু বসবে রূপসাদের বাড়ির সামনের একচিলতে মাঠটায়। ওটা তখন সোমের ‘হলেও হতে পারত’ কেস ছিল কি! জানি না। অভিজিৎ কি বাড়ি ফিরে পড়াতে বসবে, নাকি গোপনে হত্যে দেবে কৃষ-কলির বাড়ি। কে জানে! আমি আর অর্ঘ্য থাকব শুধু। রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ধ্যারতির সুরেলা আবহে আমরা দু’জনে গিয়ে বসব মহানন্দা নদীর তীরে সেই বাঁধানো রোয়াকটায়। অর্ঘ্যের অন্তরে তখন এক অধরা মাধুরীর মুখ। আর আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে আছে সেই অনিশ্চিত ভালবাসা।
অশ্রুনদীর সুদূর পাড়ে আমাদের সেই অনন্ত অপেক্ষা, কি জানি সে আসবে কবে! আসবে না, আমরা জানতাম, আসবে না। আমি আর অর্ঘ্য যেন ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’-র সেই হারু ঘোষ, ‘টিলার ওপর দাঁড়াইয়া সূর্যাস্ত দেখিবার সখ এ জীবনে মিটিল না!’ প্রতিটি মানুষকে একটা না একটা সময় ফিরতে হয়, আমাকেও ফিরতে হবে। একা একা। আরও একটা আলো-আঁধারের গল্পের দিকে। নেতাজি মোড়ে আমার জন্য প্রদীপ অপেক্ষা করে থাকবে, আর দেখা হলেই ‘কমিউনিজম ও দীপাবলি’ নিয়ে মহাতাত্ত্বিক আলোচনা শুরু করে দেবে। আজ থাক রে প্রদীপ। আজ আমাকে সেই ‘থ্রি ইন ওয়ান’ বাড়িটার সামনে যেতে হবে। আমরা বন্ধুরা মজা করে ওই নামটা দিয়েছিলাম, কারণ ওই বাড়িতে থাকত সুচরিতা-মন্দিরা-ভাস্বতী, তিন বোন। পাশেই ভূজঙ্গ ভূষণ কুন্ডুর বইয়ের দোকান। ওই দোকানের সামনের রাস্তা থেকে স্পষ্ট দেখা যায়, এক আকাশ শামিয়ানা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে থ্রি ইন ওয়ানের সেই ছাদটা। আর ওইখানে নিবিড় হয়ে আছে আমার অপূর্ণ প্রেম।
সুচরিতা ছাদে এসেছে। ওর গানের মতো হাতের ছোঁয়ায় একে একে জ্বলে উঠছে কনকপ্রদীপমালা। সুচরিতার চশমার কাচে তিরতির করে কাঁপছে অযুত দীপশিখার প্রতিবিম্ব, সে এক আশ্চর্য দীপাবলি, আমার আরও এক আলো-আঁধারের গল্প। সুচরিতা কি জানে, এই সময় ওকে শুধু প্রেমিকা নয়, পূজারিনির মতো লাগে আমার। এই ছবি আমি হারাবো না কোনওদিন ‘হৃদমাঝারে রাখব’। রাত বাড়ছে। জানি, দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার, খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছে করছে সুচরিতার হাতটা ধরতে। পারব না, জানি, পারব না। হাত কেঁপে যাবে আমার। জানি, ওকে কোনও দিনও বলতে পারব না, ‘সুচরিতা, তোকে আমি ভালবাসি’। ওর সামনে গেলে আমার সব কথা হারিয়ে যাবে। শুধু কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে, সেই গানটা বেজে চলবে আমার বুকের ভিতর, আজীবন, ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে, সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে হৃদয় আমার আকুল হল, নয়ন আমার মুদে এল রে!’ বাড়ি যেতে হবে। মায়ের মুখটা খুব মনে পড়ছে। মা নিশ্চয়ই এখন বসে আছে বাবার ছবির সামনে, মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে, ‘তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে যত দূরে আমি ধাই’। কত দূরে মা, কত দূরে চলে গেছ তুমি এখন। বাবার কাছে। জানি, ‘জীবন মরণের সীমানা ছড়ায়ে।’
শেষ রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। মার্কিন মুলুকে আমার পাহাড়ি বাড়িতে ‘ক্রমে আলো আসিতেছে।’ উদয়-আভায় রাঙা হয়ে উঠেছে পূবের বারান্দা। ধরণীর অন্য গোলার্ধে এখন দীপাবলির সেই মায়াবী সন্ধ্যা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার কত কত আলো-আঁধারের গল্প। উদ্বাস্তু পরিবারের ছেলে আমি। এই পরবাসে এখন আমার ছিন্নমূল দীপাবলি। একাকী নির্জনে আমি একটা মোমবাতি জ্বালাই। সময় আমার কাছ থেকে কত কিছু ছিনিয়ে নিয়েছে। কেড়ে নিতে পারেনি শুধু সেই সব অসম্পূর্ণ ভালবাসার গল্প। আমি একা বসে আছি স্মৃতি নিয়ে তার। আমি যেন সেই আকাশপ্রদীপ। চেয়ে আছি দূরের তারাদের পানে। ওই তারারা হারিয়ে যায় না কখনও। লুকিয়ে থাকে দিনের আলোর গভীরে। ঠিক যেন আমার সেই সব দীপাবলি, হারিয়ে যায় না। আলো-আঁধারের গল্প হয়ে থেকে যায় আমার বুকের ভিতর।