তোমরা যা পারো আমরা কুকুরেরা তা পারি না, তবু...

প্রথমটা বুঝতেই পারিনি। মাথাফাতা তালগোল-চক্কর। এক ঝলক তীব্র যন্ত্রণা। তার পর হঠাৎ সব হালকা হয়ে গেল। ঝটপট আমার প্রাণবায়ু আউট! খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। শরীরের বাইরে বেরিয়ে আসার পর বুঝলাম, বেঁচে থাকা শরীরের ভার কী ভীষণভাবে সীমাবদ্ধ করে ফেলে প্রাণীকে।

Advertisement

ডিজেল (মৃত্যুর ও পার থেকে)

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৫ ১৬:৫৭
Share:

প্যারিসের শহরতলিতে জঙ্গি হামলায় শহিদ পুলিশ কুকুর ডিজেল।

প্রথমটা বুঝতেই পারিনি। মাথাফাতা তালগোল-চক্কর। এক ঝলক তীব্র যন্ত্রণা। তার পর হঠাৎ সব হালকা হয়ে গেল। ঝটপট আমার প্রাণবায়ু আউট! খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। শরীরের বাইরে বেরিয়ে আসার পর বুঝলাম, বেঁচে থাকা শরীরের ভার কী ভীষণ ভাবে সীমাবদ্ধ করে ফেলে প্রাণীকে। আমার মুক্ত প্রাণবায়ু তখন শূন্যে উড়ছে। উড়ে বেড়াচ্ছে। হাওয়া তখনও বারুদের বাষ্পে দম বন্ধ করা।! আমার তো আর দম নিতে হবে না! আমি দেখছিলাম শুধু।

Advertisement

সেও এক নারী! আমিও এক নারী। সে এক জন মানুষ। এই মুহূর্তে কুখ্যাততম সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের এক জন ছিল। আমি এক কুকুর! ফরাসি পুলিশে আমার কাজ ছিল গন্ধ শুঁকে শুঁকে বিস্ফোরক বের করা। সাঁ দেনি-র যে বাড়িটা ঘিরে ফেলেছিল পুলিশ-সেনা, হঠাৎ সেখান থেকে বেরিয়ে এল মেয়েটা! হাতে একে ফর্টিসেভেন। গুলি চালাতে চালাতে হঠাৎ কোমরে বাঁধা বিস্ফোরক উ়ড়িয়ে দিল। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম দু’টো ছিন্নভিন্ন, টুকরো টুকরো লাশ! একটা মানুষ মেয়েটার। একটা আমার। আমরা দু’জনেই উড়ে গিয়েছি বিস্ফোরণে।

জীবনের (থুড়ি মরণের) আচমকা অভিজ্ঞতায় আমি তখন রীতিমতো চঞ্চল। এখান থেকে সেখান। সেখান থেকে এখান। এ দিক, ও দিক করতে করতে শুনলাম, আমাকে সবাই শহিদ বলছে! মানুষ শহিদ হয় জানতাম। কুকুরও তবে শহিদের মর্যাদা পায়! গর্বে ভরে উঠল প্রাণ। হঠাৎ দেখলাম সাংবাদিকদের জটলা। এক জন বলল— এই কুকুরটাকে নিয়ে একটা হিউম্যান স্টোরি করতে হবে! শুনেই রাগ হল। কিন্তু রাগ হলেই বা কী! আগে তাও ঘেউ ঘেউ করে হলেও প্রতিবাদ করার চেষ্টা করতে পারতাম। এখন তো তাও সম্ভব না। আগেও এটা শুনেছি! মানুষ যখনই কোনও জঘন্য কাজ করে, যেমন ধর্ষণ খুন ইত্যাদি ইত্যাদি, তখনই মানুষের কথায় তা পাশবিক আচরণ! আর যা কিছু ভাল, তা মানবিক! আচ্ছা, ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে এত চর্চা করা মানুষ ভেবে দেখেছ কি, এই উপমা প্রয়োগ কতটা বৈজ্ঞানিক!?!

Advertisement

পশু যা করে তা পাশবিক। বটেই তো! কিন্তু পশু কি মানুষের মতো এত ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিত সন্ত্রাস করতে পারে? এমন সন্ত্রাস কিন্তু শুধু মানুষই পারে! যা ‘পাশবিক’ বলো তোমরা, আসলে তা ‘মানবিক’!

এক দল মানুষ ঠিক করল, প্যারিস নগরীতে রক্তগঙ্গা বওয়াতে হবে। মারতে হবে! যত বেশি সম্ভব মানুষকে মারতে হবে! ভয় পাওয়াতে হবে! প্ল্যান হল! নিখুঁত প্ল্যান। হিমশীতল মাথায় তার ইমপ্লিমেন্টেশন। ১৩২ জন মানুষ দুনিয়া থেকে উধাও। কী অপরাধে? কেউ গান শুনতে গিয়েছিল। কেউ গিয়েছিল রেস্তোরাঁয় খেতে। কেউ বা ছিল পানশালায়। আচ্ছা মানুষ তোমরাই বল, পশু কি এমন ছক কষে গণহত্যা করতে পারে? করতে পেরেছে কখনও? তবু তোমাদের রোজকার ভাষায় এমন ঘটনা ‘পাশবিক’।

এমন ‘পাশবিক’ উদাহরণ তোমাদের ইতিহাসে অসংখ্য।

হিরোশিমা, নাগাসাকি (১৯৪৫) দু’লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু
টুইন টাওয়ার ধ্বংস (২০০১) প্রায় তিন হাজার মানুষের মৃত্যু
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড(১৯১৯) প্রায় এক হাজার মানুষের মৃত্যু
মুম্বই ট্রেন বিস্ফোরণ (২০০৬) ২০৯ জন মানুষের মৃত্যু
নাৎসি গণহত্যা (১৯৪১-১৯৪৫) ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু
কম্পবোডিয়ায় পল পট জমানা (১৯৭৬-১৯৭৯) ১৭ লক্ষ মানুষের মৃত্যু
অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধ (২৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু

এ তালিকা চলতেই থাকবে! আমরা কুকুরের দল, বা বণ্যপ্রাণী বাঘ-সিংহ, কারও পক্ষে এই সব হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব নয়। সম্ভব নয় এত নিখুঁত হত্যার ছক কষা! তবু তোমরা এগুলোকে উদাহরণ দাও পাশবিক হত্যাকাণ্ড বলে। সত্যি অদ্ভুত।

অনেক মানুষ মরেছিল তোমাদের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে। ধর্মযুদ্ধের পক্ষে সারথি কৃষ্ণের জ্ঞান আজও ভগবদ্ গীতা বলে পূজিত এবং পাঠ্য। তারও অনেক বছর পর, আমার এক পূর্বপুরুষ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিল স্বর্গের পথে। আসলে তিনি ছিলেন স্বয়ং ধর্ম-ঠাকুর। আমি কিন্তু সত্যিকারেরই একটা কুকুর ছিলাম। আমার ‘স্বর্গারোহন’-এও রীতি মতো ধর্ম-যোগ। এই ‘মানবিক’ কাজ সত্যিই কি কোনও পশু করতে পারবে?

(ডিজেলের আখ্যান শুনলেন মুকুল দাস)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement