বিদেশিরা ঢাকা ছাড়ায় অর্থনীতি টালমাটাল

জঙ্গি হানায় সঙ্কটের মুখে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ।পুমা থেকে নাইকি। আদিদাস থেকে ওয়ালমার্ট। গত দু’দশক ধরে পোশাক বানাতে বিশ্বের তাবড় সংস্থার ভরসা পদ্মাপারের এই দেশ, যে দেশের রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসে এই শিল্প থেকে।

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত

ঢাকা শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৬ ০৩:২৪
Share:

ঢাকার জঙ্গি হামলায় মারা গিয়েছেন জাপানেরও ৭ নাগরিক। তাঁদের কফিনবন্দি দেহ দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন জাপানের বিদেশমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা (মাঝে)। মঙ্গলবার টোকিওয়। ছবি: রয়টার্স।

জঙ্গি হানায় সঙ্কটের মুখে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ।

Advertisement

পুমা থেকে নাইকি। আদিদাস থেকে ওয়ালমার্ট। গত দু’দশক ধরে পোশাক বানাতে বিশ্বের তাবড় সংস্থার ভরসা পদ্মাপারের এই দেশ, যে দেশের রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসে এই শিল্প থেকে। এক দিকে বিদেশি মুদ্রা ঘরে আনা, অন্য দিকে মহিলাদের স্বয়ম্ভর করা— পোশাক শিল্পের হাত ধরে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। বিশ্বজুড়ে আর্থিক এই মন্দার যুগে গত কয়েক বছর ধরে ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি সম্ভব হচ্ছিল এই পোশাক শিল্পের কারণেই। কিন্তু শুক্রবার হোলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গি হানা বড়সড় ধাক্কা
দিয়েছে এই চালিকাশক্তিকে।

ব্লগার, মুক্তমনা লেখক, অধ্যাপক বা যাজক-পুরোহিতের উপর বিচ্ছিন্ন আক্রমণ চলছেই। এ ক্ষেত্রে যে ভাবে পরিকল্পনা মাফিক রেস্তোরাঁয় ঢুকে বেছে বেছে বিদেশিদের হত্যা করা হয়েছে, তাতে আগামী দিনে বিদেশি সংস্থাগুলি বাংলাদেশে ব্যবসা করতে কতটা উৎসাহী হবে, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। সরকারের বদ্ধমূল ধারণা— বাংলাদেশকে অর্থনীতিকে ঘা দিতেই এই হামলা চালানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ নীতি বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীর কথায়— বাংলাদেশকে আর্থিক ভাবে পঙ্গু করতেই পরিকল্পনা করে এই হামলা ঘটানো হয়েছে।

Advertisement

নিরাপত্তা নিয়ে সংশয়ে ইতিমধ্যেই দেশ ছাড়ছেন বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত বিদেশিরা। কোথাও প্রকাশ্যে, কোথাও বা গোপনে। যেমন গত কালই বিনা নোটিসে দেশ ছেড়েছেন পাঁচ স্পেনীয় ইঞ্জিনিয়ার। নারায়ণগঞ্জের কাছে সিদ্ধিগঞ্জে সরকারের সঙ্গে যৌথ ভাবে ৩৩৫ মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন তাঁরা। শুক্রবার হামলার পরই বাংলাদেশে বসবাসকারী তাদের নাগরিকদের জন্য বিশেষ সতর্কতা জারি করে স্পেন। তার পরেই চুপি চুপি দেশ ছাড়েন সিদ্ধিগঞ্জের ইঞ্জিনিয়াররা। বিদ্যুৎ মন্ত্রকের কর্তারা টেরটিও পাননি।

প্রশ্নের মুখে বিদেশি বিনিয়োগও। এ দেশে অন্যতম বড় বিনিয়োগকারী সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। ঘটনার পরেই পাশে
থাকার বার্তা দিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে মুখ খুললেও এ দেশে জাইকার ভবিষ্যত বিনিয়োগ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।

এ দেশে মেট্রো রেল, সড়ক নির্মাণসহ পরিকাঠামোগত উন্নয়নে গত আর্থিক বছরে প্রায় ৪৮০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে জাইকা। সড়ক পরিবহণমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রবিবারই জানিয়েছিলেন, নিহত জাপানিরা সকলেই ঢাকায় সদ্য শুরু হওয়া মেট্রো রেল প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন।

হামলার পরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন-সহ পশ্চিমি বেশ কয়েকটি দেশ তাদের নাগরিকদের এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সফরের ব্যাপারে সতকর্তা জারি করেছে। বিশেষ দরকার না-হলে আপাতত যাত্রা বাতিলের পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলি জানিয়েছে, ইদের ছুটির পরে বিদেশিদের সঙ্গে ঢাকায় তাঁদের যে বৈঠকগুলি হওয়ার কথা ছিল, তার অধিকাংশই হয়
বাতিল হয়েছে অথবা অন্য দেশে করার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। এর ফলে খরচ যেমন বাড়বে, কমবে লাভের অঙ্ক।

তবে আপাতত ঢাকার মূল দুঃশ্চিন্তা ইতালীয়দের হত্যার ঘটনা। নিহত ৬ জন ইতালীয়ই পোশাক কারখানার সাথে যুক্ত ছিলেন। এদের মধ্যে ক্রিশ্চিয়ানো রোসি, নাদিয়া বেনেদিত্ত দীর্ঘ সময় ধরে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইতালি-সহ ইউরোপের বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের বাংলাদেশে নিযে এসে পোশাক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করিয়ে দিতেন নাদিয়া।

তাঁর মৃত্যু এ দেশের পোশাক শিল্পের জন্য বিরাট ক্ষতি বলে মনে করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ গার্মেণ্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-এর অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা ফারুক হাসান মনে করেন জঙ্গি হামলা নিশ্চিত ভাবে এই শিল্পের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিই হলো তৈরি পোশাক রফতানি শিল্প। ইতালীয়দের হত্যার ঘটনায় সেই ভিত অনেকটাই নড়ে যাবে।

আতঙ্কের বাজারে আপাতত বাংলাদেশের কাছে একটাই আশার বাণী— ছয়টি রেল প্রকল্পে স্বল্প সুদে ৯০০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে চিন। এই ঋণ পেতে বছর খানেক ধরেই কূটনৈতিক দৌত্য চালিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশে থাকার ভরসা দিচ্ছে অনেক দেশই। কিন্তু দিল্লি তা যে ভাবেই নিক, এমন একটি সময়ে বেজিংয়ের এই ঘোষণা নিশ্চিত ভাবেই ঢাকাকে বাড়তি অক্সিজেন জোগাবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement