ঘরবন্দি বার্সেলোনা। —ছবি এপি।
মালদহের মেয়ে আমি। ইউরোপে আছি প্রায় এক দশক। বর্তমানে স্পেনের বার্সেলোনায় একটি সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করি। সঙ্গীতচর্চাও করি একটু-আধটু।
গত শুক্রবার, ১৩ মার্চ, আমাদের একটি কনসার্ট হওয়ার কথা ছিল। তারই রিহার্সাল দিতে গিয়েছিলাম স্কুলের পরে। সেখানে করোনা-সংক্রমণ নিয়ে প্রচুর আলাপ-আলোচনা কানে এল। এত দিন এই ধরনের চর্চা থেকে নিজেকে একটু দূরেই রাখছিলাম। কিন্তু সে দিন যে-টুকু কানে এল, তাতে বুঝলাম ৬ই ফেব্রুয়ারির পর যারা ইটালি থেকে স্পেনে এসেছে, তাঁদের ১৪ দিনের কোয়রান্টিনে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই খবরটা আমার জন্য জরুরি। কারণ, আমার বাড়িতেই দু’জন ইটালীয় থাকেন। দু’টি উড়ান সংস্থার বিমানসেবিকা তাঁরা। প্রায় রোজই তাঁদের ইটালি যেতে-আসতে হয়। তবে যাঁরা কোনও উড়ান সংস্থা বা বিমানবন্দরে কাজ করেন, তাঁদের জন্য এ ধরনের কোনও নিয়ম জারি হয়েছি কি না, বুঝতে পারলাম না।
দু’দিনের মধ্যেই এই আতঙ্ক অনেক ভয়াবহ চেহারা নিল। ‘গৃহবন্দি’ করা হল মাদ্রিদকে। সঙ্গীতশিল্পীদের কনসার্ট-টুর সব বাতিল হল। বুধবার আমরাও সিদ্ধান্ত নিলাম, ১৩ তারিখের কনসার্ট বাতিল করব।
দু’দিন আগে আমাদের এলাকায় আর একটি স্কুলে এক জন শিক্ষিকা আক্রান্ত হয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার স্কুলে গিয়ে শুনলাম, পাশের স্কুলেই ১৩ জন শিক্ষকের মধ্যে এই ভাইরাস পাওয়া গিয়েছে এবং সেই স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেই খবর পেয়ে ভয়ঙ্কর উদ্বেগে কাটল বৃহস্পতিবার দিনটা। এ প্রধান কারণ, এই দু’টি স্কুলেই এমন কিছু ‘কমন স্টাফ’ বা শিক্ষাকর্মী ছিলেন যাঁরা তখনও আমাদের স্কুলে কাজ করছিলেন। এ ছাড়া, আমাদের এক ছাত্রের মা ওই স্কুলের শিক্ষিকা; কাছাকাছি সব স্কুলের বাচ্চারা একসাথে খেলাধুলো করে। ফলে সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা ছিল।
সে দিনই স্পেনের প্রেসিডেন্ট পরের দিন, অর্থাৎ ১৩ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলেন। শিক্ষকদের বলা হল, আমাদেরও বাড়িতে থাকতে হবে। তবে আমাদের ‘ছুটি’ নয়। কোথাও কোনো প্রয়োজনে আমাদের ডাক পড়লেই আবার কাজে নামতে হবে।
স্পেনে ১২ই ফেব্রুয়ারি প্রথম সংক্রমণের খবর আসে পালমা মায়োর্কা-তে। ৩ মার্চ প্রথম মৃত্যু, ৯৯ বছরের এক মহিলার। ৭ মার্চের পর থেকে সংক্রমণ ভয়াবহ হারে বাড়তে থাকে। আজ ১৮ মার্চের বিকেল ৪টে পর্যন্ত স্পেনে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ হাজার ৯১০। মৃত্যু হয়েছে ৬২৩ জনের, সম্পূর্ণ সেরে উঠেছেন ১০৮১ জন। পুরো দেশকেই ‘লকডাউন’ বা গৃহবন্দি করা হয়েছে। সমস্ত উড়ান পরিষেবা বন্ধ। আমি যে শহরে থাকি, সেটি ক্যাটালনিয়া প্রদেশের মধ্যে। বলা হয়েছে, এই প্রদেশের বাসিন্দাদের ক্যাটালোনিয়ার বাইরে যাওয়া বা ক্যাটালোনিয়ার বাইরে থেকে এই প্রদেশে ঢোকাও নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। ওষুধের দোকান, মুদিখানা বা সুপারমার্কেট ছাড়া আর কিছু খোলা নেই এবং মানুষের শুধু এই জায়গাগুলো ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়াও নিষিদ্ধ। আইন ভাঙলে জরিমানাও লাগু করা হয়েছে।
বহু মানুষ এখন কাজহীন। সকলেই দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। কারণ কোয়রান্টিন ১৪ দিনের বেশিও হতে পারে। স্প্যানিশ সরকার আপাতত জল, বিদ্যুৎ, গ্যাস পরিষেবাগুলো বিনা শুল্কে দিচ্ছেন। কোনও স্থানীয় দোকানে খাবারদাবারের দাম এক সেন্টও বাড়েনি। ডাক্তার ও নার্সরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আমরা সাধারণ নাগরিকেরা শুধু তাঁদের কুর্নিশ জানাচ্ছি ও নিজেরা সরকারি নিয়মবিধি মেনে চলার চেষ্টা করছি।
লেখক শিক্ষিকা