Coronavirus

নিশীথ সূর্যের দেশে এ কোন অদৃশ্য দৈত্য

সাত-আট মাস প্রবল শীতের পরে যখন আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম কবে চারপাশের এই রংহীন সাদা বরফের আবরণ সরিয়ে দিয়ে ঝলমলে বসন্ত আসবে, ঠিক তখনই এক অদৃশ্য দৈত্যের মতো নেমে এল ‘কোভিড-১৯’ অতিমারি।

Advertisement

আইরিন সরকার বার্গেন (নরওয়ে)

নরওয়ে শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২০ ০৬:০২
Share:

প্রতীকী ছবি

নামটার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে একটা স্বপ্নের জগৎ— ‘নিশীথ সূর্যের দেশ’! কর্মসূত্রে থাকি নরওয়ের বার্গেন শহরে। নরওয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শহরটি প্রকৃতিপ্রেমিক ভ্রমণপিপাসুদের পক্ষে স্বর্গরাজ্য। সব কিছুই যেন শিল্পীর হাতে আঁকা ছবির মতো সুন্দর! এই রূপকথার রাজ্যেও হঠাৎ এক দিন ঘনিয়ে এল দুঃসময়।

Advertisement

সাত-আট মাস প্রবল শীতের পরে যখন আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম কবে চারপাশের এই রংহীন সাদা বরফের আবরণ সরিয়ে দিয়ে ঝলমলে বসন্ত আসবে, ঠিক তখনই এক অদৃশ্য দৈত্যের মতো নেমে এল ‘কোভিড-১৯’ অতিমারি। কিছু দিন আগে থেকেই আমরা খবর পাচ্ছিলাম যে এই রকম একটি অতিমারি ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। ক্রমে এর প্রভাব পড়তে শুরু করল আমাদের জীবনযাপনেও। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথিবীর নানা দেশের ছাত্রছাত্রীরা উচ্চশিক্ষার জন্য আসেন ‘এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্ট’ হিসেবে। প্রথম প্রথম শুনছিলাম এই বছর সংক্রমিত দেশের ছাত্রছাত্রীদের আসার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়। তখনও কোভিড-১৯ নরওয়েতে তেমন প্রকোপ ফেলতে পারেনি। কিন্তু ক্রমে ক্রমে এই রোগটি যে গ্রাস করতে যাচ্ছে আমাদের শহরকেও তা বুঝতে পারছিলাম কারণ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই রয়েছে হাসপাতাল। আস্তে আস্তে বিধিনিষেধ বাড়তে লাগল। জানা গেল যে খুব জরুরি কারণ ছাড়া অন্য দেশে যাওয়া যাবে না আর যদি কেউ যান তা হলে ফিরে এলে তাঁকে ১৫ দিন কোয়রান্টিনে থাকতে হবে। চারদিকে পোস্টার লাগানো হল এবং ফোনে বার্তা পাঠিয়ে বার্গেন পুরসভা থেকে জানানো হল কী ভাবে নিজেকে এবং অন্যদের এই সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। ক্রমে ক্রমে নরওয়েতেও রোগীর সংখ্যা বাড়ছিল আর তাই আমরা বুঝতেই পারছিলাম যে নিয়ম আরও কঠিন হবে এবং সীমাবদ্ধতাও আরও বাড়বে। এর মধ্যেই মার্চ মাসের মাঝামাঝি একদিন শুরু হল লকডাউন। ইউরোপের সব দেশের মধ্যে নরওয়েতে একদম প্রথম দিকে লকডাউন শুরু হয়েছিল।

আরও পড়ুন: ‘ডাক্তাররা ধরেই নিয়েছিলেন আমি মরছি’, মুখ খুললেন বরিস জনসন

Advertisement

একটি ছোট দেশ হওয়ার দৌলতেই হোক বা নরওয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থা যথাযথ বলেই হোক, এখানকার মানুষজন খুবই নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলেন। এমনিতেই লোকসংখ্যা খুব কম, তার উপরে আবার লকডাউন। চারদিক তাই জনহীন, সুনসান। সব দোকানপাট বন্ধ, অত্যাবশ্যক পণ্য এবং ওষুধের দোকান ছাড়া। এত ফাঁকা রাস্তাঘাট, বিশেষত এখানকার ‘সামারে’, তা একেবারেই অভাবনীয়! গণপরিবহণ চলছে, কিন্তু স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম এবং সেগুলোও ফাঁকা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, ল্যাবরেটরিতে এক্সপেরিমেন্ট করা যাচ্ছে না। কিন্তু বাড়ি থেকে অন্যান্য কাজ চলছে পুরোদমেই। আগের এক্সপেরিমেন্টের তথ্য বিশ্লেষণ করা এবং ‘পেপার’ লেখার কাজ তো আছেই। তার সঙ্গে ক্লাস নেওয়া, বিভিন্ন মিটিং, সেমিনার সবই হচ্ছে অনলাইনে। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হচ্ছিল কিন্তু এখন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। অবশ্য ‘মিস্’ করছি সহকর্মী-বন্ধুদের সঙ্গে ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দেওয়া, এখানকার ছোট ছোট কাফেতে বসে চা-কফি খাওয়া আর সন্ধেবেলা ল্যাবরেটরি থেকে ফিরে সাঁতার কাটতে যাওয়া!

এখানকার স্বাস্থ্যব্যবস্থা রোগী এবং স্বাস্থ্যকর্মী উভয়ের প্রতিই যথেষ্ট সংবেদনশীল। তাই অল্পদিনের মধ্যেই হাসপাতালগুলোয় এই মারণব্যাধির সঙ্গে লড়াই করার নানা রকম বন্দোবস্ত ও প্রস্তুতি নেওয়া হল। সাধারণ মানুষও যথেষ্ট সচেতন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেনাকাটা না-করা, রাস্তায় পরস্পরের সঙ্গে ১ মিটার দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি নিয়ম তাঁরা যথাযথভাবেই পালন করছেন। এ ছাড়া, বার্গেন পুরসভা খুবই সক্রিয় ভাবে বয়স্ক মানুষদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌছে দেওয়া, জনসাধারণের জন্য হেল্পলাইন তৈরি করা, এমনকি ব্যক্তিগত ভাবে প্রত্যেককে ফোনে বার্তা পাঠানো ইত্যাদি করে চলেছে।

(লেখক ইউনিভার্সিটি অব বার্গেনে গবেষক)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement