প্রতীকী ছবি।
একটা আশঙ্কা তৈরি হচ্ছিল। প্রকাশ্যে আসছিল না। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসক লর্না ব্রিনের আত্মহত্যা সেই আশঙ্কাকেই সত্যি প্রমাণ করল। কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন লর্না, যাকে বলা হয় ‘ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার’। তিনিও সংক্রমিত হয়েছিলেন। সুস্থ হওয়ার পরে কর্মক্ষেত্রে ফেরেনও। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সব চেষ্টার পরেও রোগীদের বাঁচাতে না পারার ব্যর্থতা তাঁর মধ্যে মানসিক অবসাদ তৈরি করেছিল। তাঁর আত্মহত্যার কারণ হিসেবে এই অবসাদকেই দায়ী করছেন মনোবিদ এবং লর্নার পরিবারের সদস্যেরা। এই ঘটনার পরেই কোভিড-যুদ্ধের প্রস্তুতিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিই দেওয়ার পাশাপাশি মানসিক অবসাদ কাটাতে কাউন্সেলিংয়েরও প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। না হলে স্বাস্থ্য পরিষেবায় বিপর্যয় নামার আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
এই প্রেক্ষিতেই চিকিৎসকদের মানসিক অবসাদ নিয়ে অতীতে করা একটি গবেষণা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ‘আমেরিকান সাইকায়াট্রি অ্যাসোসিয়েশন’-এর করা ওই গবেষণা বলেছিল, অন্য পেশার থেকে চিকিৎসকদের আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। চেন্নাইয়ের ক্যানসার শল্য চিকিৎসক অরবিন্দ কৃষ্ণমূর্তি বলেন, ‘‘সকলেরই ধারণা, ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরা চিকিৎসা পরিষেবা দিতে অভ্যস্ত। ফলে পরিস্থিতি যেমনই হোক, তাঁরা ঠিক মানিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু কোভিড ১৯-এর মতো পরিস্থিতিতে এটা ধরে নেওয়া খুব ভুল হবে। কারণ, একটা জিনিস ভুললে চলবে না যে এই সংক্রমণ নিয়ে সকলের মধ্যেই অনিশ্চয়তা, ভয় কাজ করছে। সেটাই স্বাভাবিক। তাই স্বাস্থ্যকর্মীদের উপরে মানসিক কোনও প্রভাব পড়বে না ভেবে নেওয়াটা ঠিক নয়।’’ এক
দিকে সাম্প্রতিক পরিস্থিতির চাপ। অন্য দিকে, পারিবারিক জীবনের ছন্দ ভেঙে যাওয়া। সবক’টি বিষয় চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে তুলছে বলে জানাচ্ছেন মনোবিদেরা।
কিংস কলেজ লন্ডনের ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি, সাইকোলজি অ্যান্ড নিউরোসায়েন্স’-এর এমেরিটাস প্রফেসর দীনেশ ভুগরা জানান, বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে লড়তে লড়তে স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। কারণ, কোভিড ১৯-এর অস্বাভাবিক সংক্রমণের হার, প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি ও সেই সঙ্গে পুরো পরিস্থিতি নিয়ে অনিশ্চয়তা— এই সব কিছুই বিপর্যস্ত করে তুলছে তাঁদের। দীনেশের কথায়, ‘‘এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘পেশাদারি ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছি’, এই মনোভাব। যাবতীয় চেষ্টার পরেও যখন কোনও রোগীকে বাঁচানো যাচ্ছে না, তখন অনেক চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীর মনেই নিজেদের পেশাদারিত্ব, কাজের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন জাগছে। যা আরও বিপন্ন করে তুলছে তাঁদের।’’
‘ব্রেন বিহেভিয়র রিসার্চ ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া’-র চেয়ারপার্সন মীনা মিশ্র বলেন, ‘‘এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনের ছন্দও নষ্ট করে দিয়েছে। প্রতি মুহূর্তে সঙ্কটের মোকাবিলা করা, তা-ও একদম সামনে থেকে, তা তাঁদের মানসিক চাপ তৈরি করছে। অথচ তা কাটিয়ে ওঠার কোনও উপায় নেই। কারণ, কাজে তো তাঁদের যেতেই হবে।’’ এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক অবসাদ কাটাতে প্রশাসনের উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করছেন অনেকে।
আরও পড়ুন: রাজ্যের কোভিড তথ্য নিয়ে ফের মমতাকে তোপ ধনখড়ের
দিল্লির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (আইআইটি) ‘হিউম্যানিটিজ় অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস’ বিভাগের সাইকোলজির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর তথা ‘ন্যাশনাল পজ়িটিভ সাইকোলজি অ্যাসোসিয়েশন’-এর সেক্রেটারি কমলেশ সিংহ বলেন, ‘‘অনেক জায়গাতেই কোভিড-১৯ পরিস্থিতির জন্য কাউন্সেলিং শুরু হয়েছে। কিন্তু সেগুলি সবই সাধারণ মানুষের জন্য। শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক অবসাদ কাটাতে বিশেষ কাউন্সেলিং চালু করা প্রয়োজন। যার মাধ্যমে মানসিক চাপ তাঁরা অতিক্রম করতে পারবেন।’’ কলকাতার ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’-র অধিকর্তা প্রদীপ সাহা বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষের কাছে বাড়ি থেকে না বেরোনো, সংক্রমণের খবর পড়া বা দেখা বন্ধ করার সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ, এই সুইচ অন বা অফের সুযোগটা অন্যদের রয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্মীদের নেই। ফলে তাঁদেরও কাউন্সেলিং জরুরি।’’