—প্রতীকী ছবি।
ক্যালিফোর্নিয়ায় জাতভিত্তিক বৈষম্যকে ‘অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য বিল আনতে চেয়েছিলেন ডেমোক্র্যাট দলের কয়েক জন কংগ্রেস সদস্য। একটি শক্তিশালী ভারতীয় শিবিরের বিরোধিতায় সেই বিলে ভিটো দিয়ে দিলেন এই প্রদেশের ডেমোক্র্যাট গভর্নর গেভিন ক্রিস্টোফার নিউসাম।
এ বছর ফেব্রুয়ারিতে সিয়্যাটলের সিটি কাউন্সিলে আমেরিকায় বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিল পাশ হয়েছিল। এই বিলে জাতভিত্তিক কারণে বৈষম্যমূলক আচরণকে নিষিদ্ধ করা হয়। সিয়্যাটলই আমেরিকার প্রথম শহর, যেখানে এই ধরনের আইন চালু করা হল। তার পরে সেপ্টেম্বরে ক্যালিফোর্নিয়ার ফ্রেসনো শহরও একই মর্মে একটি বিল পাশ করে।
পুরো ক্যালিফোর্নিয়া প্রদেশেই এই ধরনের আইন চালু করার জন্য বেশ কিছু দিন ধরে আন্দোলন চালাচ্ছেন এখানকার কয়েক জন ডেমোক্র্যাট সেনেটর। তাঁদের মধ্যে অন্যতম আইশা ওয়াহাব। মার্চ মাসে তিনি যে বিলটি প্রাদেশিক সেনেটে পেশ করেছিলেন, তার সরকারি নাম ‘সেনেট বিল ৪০৩’। প্রায় কোনও বাধা ছাড়াই, রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দু’দলেরই কংগ্রেস সদস্যদের অধিকাংশের অনুমোদন পেয়ে বিলটি সেনেটে পাশ হয়ে গিয়েছিল। বিলটি আইনে রূপান্তরিত হতে প্রয়োজন ছিল শুধু গভর্নরের অনুমোদন।
ক্যালিফোর্নিয়ায় যে-হেতু ডেমোক্র্যাট গভর্নর, তাই এই বিল পাশ হতে কোনও সমস্যা হবে না বলেই মনে করেছিলেন আইশারা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বিলে ভিটো দিয়ে দিয়েছেন গভর্নর। তাঁর কথায়, ‘‘আলাদা করে এই বিলের কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমি মনে করি না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দেশ ও লিঙ্গভিত্তিক বিদ্বেষমূলক বিভিন্ন আচরণ রুখতে ক্যালিফোর্নিয়ায় যথেষ্ট কড়া আইন রয়েছে। জাতভিত্তিক বৈষম্য এই আইন দিয়েই রোখা যাবে।’’
বিল আনতে এত দিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন যে সব ডেমোক্র্যাট সেনেটর, গভর্নরের এই ভিটোর পিছনে এখন তাঁরা ‘আসল’ কারণ খুঁজছেন। তাঁদের দাবি, অত্যন্ত বিত্তশালী এক দল ভারতীয় বংশোদ্ভূতের আপত্তিতেই এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছেন গভর্নর নিউসাম।
সিয়্যাটলে পাশ হওয়া বিলটির উদ্যোক্তা সিয়্যাটল সিটি কাউন্সিলের সদস্য ক্ষমা সাওয়ন্তের কথায়, ‘‘জাত ভিত্তিক বৈষম্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ দেখতে পান না। তার অন্যতম প্রধান কারণ, ভারতীয়দের মধ্যে বিভিন্ন পেশায় উচ্চপদে যাঁরা সফল, তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই ‘উচ্চবর্ণের’। ফলে তাঁদের পক্ষে বলা খুব সহজ যে, তাঁরা এই বিষয়টি উপলব্ধি করেন না।’’
এই কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই স্থানীয় ‘বস্টন সাউথ এশিয়ান কোয়ালিশন’-এর সদস্য সোমনাথ মুখোপাধ্যায়ের গলায়। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা প্রতিদিনের জীবনে দেখতে পাই না বলে এই বৈষম্য নেই বলাটা সম্পূর্ণ ভুল।’’ তাঁদের সংস্থা আমেরিকার আরও অনেকগুলি সংগঠনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তৈরি করেছে একটি জোট— ‘আমেরিকা এগেনস্ট কাস্ট ডিস্ক্রিমিনেশন’। এর মধ্যে রয়েছে সারা আমেরিকার অম্বেডকর-পন্থা অনুসরণকারী সংগঠনগুলি এবং বিভিন্ন শিখ, মুসলিম, প্রগতিশীল হিন্দু, শ্রমিক ও সমাজবাদী সংগঠন। সিয়্যাটল শহরে এই বিল পাশ হওয়ার পরে তাঁদের পরের, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, পদক্ষপ ছিল ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট অ্যাসেম্বলিতে জাতভিত্তিক বৈষম্য নিষিদ্ধকরণের বিল পাশ করা।
ক্যালিফোর্নিয়াকে আমেরিকার সবচেয়ে ‘প্রগতিশীল’ রাজ্য বলে গণ্য করা হয়। আগ্নেয়াস্ত্রজনিত আইন হোক বা গর্ভপাত অধিকার রক্ষার আইন—ক্যালিফোর্নিয়া অন্য প্রদেশের থেকে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু এই বিলের জোরালো বিরোধিতা করেছিল এ দেশের অন্যতম শক্তিশালী হিন্দু সংগঠন ‘হিন্দু আমেরিকান ফাউন্ডেশন’। তাদের মতে, এই বিল এ দেশের হিন্দুদের মধ্যে বিভেদ এনে দেবে, ‘উচ্চবর্ণের’ পদবীর হিন্দুদের অযথা আইনি সঙ্কটে পড়তে হবে।
আমেরিকার একটি প্রথম সারির সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান অজয় জৈন ভুতোরিয়া গভর্নর নিউসামকে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের একটা বড় অংশ এখন পর্যন্ত ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকেই আর্থিক এবং রাজনৈতিক ভাবে সমর্থন করে আসছে। কিন্তু এই বিল গভর্নর সমর্থন করলে, ডেমোক্র্যাটেরা সেই সমর্থন হারাবে। গভর্নর সাম যদিও এই ‘হুমকির’ কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন।
আইন পাশ না হলেও এত দিন ধরে চলা আন্দোলনকে ‘জয়’ হিসেবেই দেখছেন সোমনাথেরা। তাঁরা মনে করছেন, আংশিক হলেও জাতভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই সফল হয়েছে। যেমন, ক্যালিফোর্নিয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটি-সহ আমেরিকার বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বৈষম্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।