বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ দেশের প্রতিটি কোণায়। সামরিক শক্তিতেও গোটা বিশ্বের সমীহের পাত্র। এ হেন মজবুত রাষ্ট্র অসহায় হয়ে নিজেদের কোষাগার খালি হয়ে যেতে দেখছে।
চিনা পুঁজিপতিদের অনেকেই দেশ থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে এখন পাড়ি দিচ্ছেন অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, স্পেন। নিজেদের পুঁজিও চেঁছেপুঁছে নিয়ে যাচ্ছেন সঙ্গে। চিনে জীবন কাটানো খুব সহজ নয়। দেশান্তরী চিনা বিলিয়নেয়ার, মিলিয়নেয়ারদের মুখে এখন অনেকটা এই ধরনের কথাই শোনা যাচ্ছে।
কেন নিজের দেশ, নিজের পরিচিত পরিসর ছেড়ে অজানা, অচেনা মুলুকে চলে যাওয়ার এই প্রবণতা চিনের ধনী নাগরিকদের মধ্যে?
প্রথমত, চিনের পুঁজিপতি এবং উচ্চবিত্তের মানুষ মনে করছেন, এত কঠোর সরকারি নিয়ন্ত্রণ কাম্য নয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পসারণের উপর কঠোর সরকারি নিয়ন্ত্রণ। খুব চড়া হারে আয়কর দিতে হয়। চিনে সেস-ও বিশ্বে সর্বোচ্চ হারে। ফলে পুঁজিপতিরা মনে করছেন, চিনে ব্যবসা-বাণিজ্য সুখকর নয়। প্রধানত সেই কারণেই সমস্ত পুঁজি সঙ্গে নিয়ে দেশান্তরী হওয়া শুরু করেছেন।
দ্বিতীয়ত, চিনা উচ্চবিত্ত এখন পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়েও অন্য রকম করে ভাবতে শুরু করেছে। চিনের নাগরিকদের জন্য ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের দরজা বন্ধ। চিনে বসবাস করছেন যে বিদেশি নাগরিকরা, তাঁরা নিজের সন্তানদের ইন্টারন্যাশনাল স্কুল বা বহুজাতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াতে পারেন। কিন্তু, চিনা নাগরিকের সামর্থ্য থাকলেও ওই সব প্রতিষ্ঠানে সন্তানকে ভর্তি করতে পারবেন না তিনি। সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিদেশে চলে গেলে সে সব অসুবিধা থাকছে না। সন্তানের শিক্ষা এবং প্রতিষ্ঠার জন্য পয়সা খরচ করলেই সেরা সুযোগ-সুবিধা অপেক্ষা করছে সেখানে। আর সন্তানের জন্ম যদি বিদেশে হয়, তা হলে সে জন্মসূত্রে বিদেশি নাগরিক। তার পর চিনে ফিরতেও অসুবিধা নেই। কারণ, তখন চিনে ফিরলে ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়তে আর বাধা থাকবে না।
বেজিং-এর তিয়েন আন মেন স্কোয়্যারেও মাস্ক পরে ঘুরতে হচ্ছে।
তৃতীয়ত, চিনের পরিবেশ দিন দিন দূষিত হচ্ছে বলেও মনে করছেন সে দেশের ধনী শ্রেণি। আর্থিক বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেপরোয়া শিল্পায়ন হয়েছে চিনে। শিল্পের বর্জ্য এবং ধোঁয়ায় বড় শহর আর শিল্পাঞ্চলগুলির আকাশ ঢেকে থাকে। বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সহজলভ্য তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনও বাড়াতে হয়েছে। বাতাসে রোজ মিশছে সেই ধোঁয়া। বেজিং-এর আকাশজুড়ে ঘন ধোঁয়াশার আস্তরণ আর দূষণের কালচে মেঘের ছবি এখন গোটা বিশ্বই দেখতে পাচ্ছে। ধনী শ্রেণি তথা পুঁজিপতিরা বলছেন, পয়সা খরচ করলে যখন বিশুদ্ধ পরিবেশে বাঁচার সুযোগ রয়েছে, তখন চিনে থাকার মানে হয় না।
চতুর্থত, চিনে বিশুদ্ধ পানীয় জলের আকালও দিন দিন বাড়ছে। বেপরোয়া শিল্পায়নে ভূগর্ভস্থ জল বিপুল হারে তুলে নেওয়ার জেরেই জলস্তর ক্রমশ নামছে। নিরাপদ পানীয় জলের অভাব ধীরে ধীরে বড়সড় সঙ্কটের আকার নেবে, মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই সব নানা কারণে বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে চিন ছেড়ে পুঁজিপতিদের বিদেশে চলে যাওয়া। প্রবণতা বছর বছর বাড়ছে। আর পুঁজিপতিরা চিন ছাড়তে চাইছেন বুঝেই তাঁদের আশ্রয় দেওয়ার লোভনীয় প্যাকেজ ঘোষণা করে দিয়েছে বেশ কয়েকটি দেশ। কারণ, ১০ লক্ষ মিলিয়নেয়ারের বাস চিনে। তাঁদের সঙ্গে তাঁদের টাকাপয়সাকেও নিজেদের দেশে নিঃশেষে টেনে নিতে পারলে মন্দায় ঝিমিয়ে যাওয়া অর্থনীতি আবার অক্সিজেন পাবে। যে দেশের প্যাকেজ পছন্দ হচ্ছে, চিনের বিভিন্ন অংশ থেকে সেই দেশেই পাড়ি দিচ্ছেন ধনী মানুষজন। সঙ্গে করে অবশ্যই নিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের অতুল ঐশ্বর্য।
এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক এই সব বিদেশি পুঁজিপতিদের আকর্ষণের জন্য কী ধরনের প্রস্তাব রেখেছে অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ব্রিটেন এবং অন্যান্য পশ্চিমি দেশ। শুধুমাত্র চিনা পুঁজিপতিদের কথা উল্লেখ করে কোনও আলাদা নীতি কোনও দেশ তৈরি করেনি। কিন্তু, বিদেশি পুঁজিপতিকে আশ্রয় দেওয়ার শর্ত একটু শিথিল হলেই যে চিন থেকে অনেক ধন-সম্পদ নিজেদের দেশে টেনে আনা সম্ভব, তা বুঝেছে এই সব দেশ। সেই অনুযায়ীই এই সব দেশ প্যাকেজ তৈরি করেছে বিদেশি আশ্রয়প্রার্থীর জন্য। নিলামের মতো এই দর হাঁকাহাঁকিতে অস্ট্রেলিয়া সবাইকে পিছনে ফেলেছে। ৫০ লক্ষ অস্ট্রেলিয়ান ডলার বা ৩৬ লক্ষ মার্কিন ডলার খরচ করলেই বিদেশি আশ্রয়প্রার্থীকে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দিয়ে দিচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। ইনভেস্টমেন্ট ভিসা দেওয়া হচ্ছে বিদেশি পুঁজিপতিদের। পরিকাঠামো এবং সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে ষথেষ্ট উন্নত অস্ট্রেলিয়া চিনা পুঁজিপতিদের কাছে সব সময়ই বেশ লোভনীয় জায়গা। তাই সবচেয়ে বেশি চিনা পুঁজিপতি গত কয়েকবছরে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়।
দূষণের জেরে এখন এমনই ধোঁয়াশা চিন জুড়ে।
আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পেতে গ্রিন কার্ড জরুরি। গ্রিন কার্ড পেতে মাত্র ১০ লক্ষ মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়। ২ বছরের জন্য ১০ জনের কর্মসংস্থান করতে পারে এই অর্থ। দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্যই মার্কিন সরকার এইভাবে বিদেশ থেকে পুঁজি টানতে চাইছে। তবে ইবি-৫ প্রোগ্রাম বলে একটি প্রকল্পও মার্কিন সরকার চালু করেছে। সেই প্রকল্পে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে পাড়ি জমানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শহরাঞ্চলে বিনিয়োগ করলে ১০ লক্ষ মার্কিন ডলারই দিতে হবে। যাঁরা একটু ঝুঁকি নিয়ে গ্রামীণ আমেরিকায় বিনিয়োগ করবেন, তাঁদের জন্য বিনিয়োগের পরিমাণ অর্ধেক। তার বিনিময়ে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের ছাড়পত্র মিলবে। আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের দেওয়া হিসেব বলছে, গত এক বছরে লগ্নিকারী ভিসা পাওয়ার জন্য আমেরিকায় যতগুলি আবেদনপত্র জমা পড়েছে, তার ৮০ শতাংশই চিন থেকে এসেছে। চিনা পুঁজিপতিরা এ ভাবেই দলে দলে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন আমেরিকায়।
ব্রিটেনে বসবাসের শর্ত একটু শক্ত। ১০ লক্ষ পাউন্ড বিনিয়োগ করলে সেখানে ৫ বছরের জন্য থাকার ছাড়পত্র মিলবে। স্পেনে পাড়ি দেওয়া আবার খুব সহজ। ন্যূনতম ৫ লক্ষ ইউরো মূল্যের একটি সম্পত্তি সে দেশে কিনতে পারলেই হল। সারা জীবন স্পেনে থাকার অনুমতি মিলে যাবে। শুধু ওই সম্পত্তি বিক্রি করা চলবে না।
কানাডা অবশ্য উল্টো পথে হেঁটেছে। বলা ভাল হাঁটতে বাধ্য হয়েছে। আগে সহজ শর্তে কানাডার লগ্নিকারী ভিসা মিলত। তাতে চিনের ধনী শ্রেণির এত বিপুল হারে মানুষ কানাডায় ভিড় জমাতে শুরু করেন, যে এ বছরের গোড়াতেই নিজেদের লগ্নিকারী ভিসা নীতি বাতিল করেছে কানাডার সরকার। কানাডায় বসবাসের অনুমতি বড্ড সস্তা হয়ে যাচ্ছিল বলে কানাডার সরকার জানিয়েছে।
যে ভাবে দেশ ছাড়ছেন চিনা পুঁজিপতিরা, তাতে সে দেশের অর্থনীতি বড়সড় ধাক্কা খেয়ে যেতে পারে। বেজিং-এর কমিউনিস্ট সরকার সতর্ক হবে কি?