মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করল রাষ্ট্রপুঞ্জ। —ফাইল চিত্র।
দু’দশকের চেষ্টায় অবশেষে সাফল্য। আন্তর্জাতিক চাপের কাছে অবশেষে নতিস্বীকার করল চিন। বেজিংয়ের আপত্তি উঠতেই জইশ-ই-মহম্মদ প্রধান মাসুদ আজহারকে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করল রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ। এই তালিকায় অন্তর্ভুক্তির ফলে মাসুদের সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হবে। পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হবে তার গতিবিধি। এটা ভারতের বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল শিবির। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলে সন্ত্রাসে মদতের প্রশ্নে আরও চাপে পড়ল পাকিস্তান।
আজ বুধবার রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সন্ত্রাস বিষয়ক ‘১২৬৭ কমিটি’র বিশেষ বৈঠক হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের এই বিশেষ কমিটি বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নীতি নির্ধারণ করে। এর আগে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই প্রস্তাবে বাধা দিয়েছে চিন। কিন্তু কূটনৈতিক সূত্রে খবর, বুধবার আর আপত্তি করেনি বেজিং। ফলে মাসুদকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী ঘোষণার পথে সব বাধা কেটে যায়। পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ-ই-মহম্মদ প্রধান মাসুদ আজহার এবার থেকে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী’।
তার তাৎপর্য কী? রাষ্ট্রপুঞ্জের তালিকায় কেউ সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হলে তার গতিবিধি প্রায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হতে বাধ্য। রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্য যে কোনও দেশে ওই ব্যক্তিকে দেখামাত্র গ্রেফতার করতে হবে। সদস্য দেশগুলি রাষ্ট্রপুঞ্জের এই নির্দেশিকা মানতে কার্যত বাধ্য। ফলে মাসুদকে গ্রেফতার করা ছাড়া আর কোনও বিকল্প পাকিস্তানের হাতে থাকবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
বেজিং অবশ্য আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিল। গতকাল মঙ্গলবারই চিনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র জেং শুয়াং সংবাদ মাধ্যমে জানান, মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী ঘোষণার পথে ‘সদর্থক অগ্রগতি’ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘আমি মনে করি বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান হবে।’’ বেজিংয়ের এই ঘোষণার পরই আশার আলো দেখতে শুরু করেছিল ভারত। শেষ পর্যন্ত টুইটারে সুখবর দিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ আকবরউদ্দিন। পাশে থাকার জন্য সব দেশকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন: হাতে আর এক দিন! ইরানি তেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলতে আমেরিকাকে অনুরোধ দিল্লির
যদিও প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল আরও আগে। এ বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় আত্মঘাতী জঙ্গি হানায় পাক মদতপুষ্ট জইশ-ই-মহম্মদের নাম উঠে আসে। সংগঠনের চাঁই হিসেবে নাম জড়ায় মাসুদেরও। তার পর থেকেই মাসুদকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী ঘোষণায় নতুন করে তোড়জোড় শুরু হয়। মার্চের গোড়ার দিকে নয়া প্রস্তাব তৈরি করে আমেরিকা, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। প্রস্তাবের খসড়া পেশ হয় ‘১২৬৭ কমিটি’র বৈঠকে। কিন্তু সেই প্রস্তাবে ‘পদ্ধতিগত ত্রুটি’র কথা বলে আপত্তি জানায় চিন। এ বার অবশ্য আর বাগড়া দেওয়ার চেষ্টা করেনি।
কেন? কূটনৈতিক শিবিবের যুক্তি, সব পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের বন্ধু চিন বারবার ভেটো দেওয়ায় বেজিংয়ের উপর তৈরি হচ্ছিল পাহাড় প্রমাণ কূটনৈতিক চাপ। তার উপর শেষ বারের বাধা দেওয়ার পর আমেরিকা, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স সেই চাপ গত দু’মাসে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। তার সঙ্গে ছিল নরমে-গরমে নয়াদিল্লির কূটনৈতিক প্রচেষ্টা। এমনকি, গত সপ্তাহেও বিদেশ সচিব বিজয় গোখেল বেজিংয়ে গিয়ে মাসুদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ দিয়ে এসেছেন শি জিনপিং সরকারের হাতে।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
আরও পড়ুন: ‘বদলার খিদে মেটেনি’, ভারত ও বাংলাদেশে নতুন করে সন্ত্রাসের হুমকি দিল আইএস
সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল চিন। সেটাও মূলত, পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে। গত কয়েক মাসে এই বিষয়টিও চিনকে বোঝাতে পেরেছেন আন্তর্জাতিক স্তরের কূটনীতিবিদরা। তাছাড়া এ বারও অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালে সেই চাপ যে আরও বাড়ত, তা আন্দাজ করতে অসুবিধা হয়নি চিনেরও। তাই এত চাপ উপেক্ষা কার্যত গোটা বিশ্বের বিরুদ্ধে চলে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে বা সাহস দেখাতে পারেনি চিন। সেই কারণেই এই নমনীয় অবস্থান, মত কূটনীতিকদের।