ওডেসা বন্দরে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে জাহাজ। ছবি: রয়টার্স।
আমি একটি মালবাহী জাহাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। সেই সূত্রেই গত ১১ জানুয়ারি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। তখনও জানতাম না কোন দেশে যেতে হবে। হঠাৎ শুনলাম গন্তব্য ইউক্রেনের বন্দর শহর ওডেসা। শুনে একটু ত্রস্ত হই। চিন্তায় পড়ে যান আমার স্ত্রী-পুত্রও। সকলের একটাই চিন্তা— একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যাব, কী পরিণতি হবে কে জানে! যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে আমাদের সংস্থার অন্যান্য জাহাজ ওডেসায় গিয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওখানকার পরিস্থিতি খুব একটা খারাপ নয়। তবে সাইরেনের আওয়াজ পেলেই সকলে মাটির নীচের বাঙ্কারে ঢুকে পড়েন। এই সব শুনে একরাশ উত্তেজনা নিয়ে যাত্রা করলাম ওডেসার উদ্দেশে।
এ শহরে এসে পৌঁছনোর পরে অবশ্য আশঙ্কার সমস্ত মেঘ কেটে গেল। এ শহরে যুদ্ধের কার্যত কোনও আঁচ নেই। আগে থেকে না জানলে বোঝার উপায় নেই যে, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভয়ঙ্কর লড়াই চলছে। একটা ঘরবাড়িতেও কোনও আঁচড় নেই। তবে যুদ্ধের প্রভাবে এখানকার লোকজনের সংখ্যা অনেকটা কমে গিয়েছে বলে শুনলাম। স্থানীয় রেস্তরাঁয় গিয়েছিলাম। ওখানে এক দল ভারতীয় পড়ুয়ার সঙ্গে দেখা হল। এখানে ডাক্তারি পড়ছেন। জানালেন, গত বছর যুদ্ধ শুরুর পরে এ শহরেও বোমা পড়েছিল, তবে তা শুধু সরকারি ভবনে। প্রথম প্রথম তাঁরাও খুব উদ্বেগে দিন কাটাতেন। এখন জনজীবন স্বাভাবিক। স্কুল-কলেজ-দোকানপাট খোলা। তবে যুদ্ধের অভিঘাতে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গিয়েছে।
স্থানীয় এক বন্দরকর্মীর কাছ থেকে জানলাম, মারিয়ুপোলে যেখানে জাহাজে মালপত্র তোলা হয়, সেখানে একটা ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছিল। পাশেই জাহাজ ছিল। জাহাজের অবশ্য ক্ষতি হয়নি। ওডেসায় রুশ আক্রমণ ততটা ধারালো না হওয়ার একটা কারণ হল, এখানে বহু রাশিয়ান বসবাস করেন। তার জন্যই হয়তো ভ্লাদিমির পুতিনের বাহিনী তেমন হামলা চালায়নি।
ইউক্রেনের জলসীমায় ঢোকার আগে অবশ্য আমাদের দীর্ঘক্ষণ মাঝসমুদ্রে অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমাদের জাহাজ তখন কৃষ্ণসাগরের বসফরাস প্রণালীতে। শুনলাম, পর্যবেক্ষকের একটি বিশেষ দল আসবে আমাদের জাহাজে তদন্ত করতে। জাহাজে করে অস্ত্র পাচার করা হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে সরেজমিনে দেখতে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে ইউক্রেন ও দক্ষিণ-পশ্চিম রাশিয়ার বন্দর শহরগুলি থেকে জাহাজ চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অগস্ট থেকে আস্তে আস্তে ফের চালু হয়। তখনই ইউক্রেন, রাশিয়া, তুরস্ক (কৃষ্ণসাগরের দক্ষিণে তুরস্ক আর উত্তরে ইউক্রেন) ও রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিনিধিদের নিয়ে এই তদন্তকারী গোষ্ঠী তৈরি হয়। তাঁদেরই সাত-আট জন প্রতিনিধি এক দিন আমাদের জাহাজে এলেন। খুঁটিয়ে দেখে রিপোর্ট দিলেন। তার পরে নোঙর ফেলার অনুমতি পেলাম ।
ওডেসা শহরটি খুব সুন্দর। এখানে বহু পর্যটক আসেন। তবে যুদ্ধের প্রভাবে পর্যটন ব্যবসায় এখন মন্দা। এখানকার দু’টো গির্জায় গিয়েছিলাম। স্থাপত্য দেখে মন ভরে গেল। এখানকার মানুষ খুব শান্তিপ্রিয়। যুদ্ধের জেরে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিকিকিনিও কম। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রভাব পড়লেও স্থানীয়েরা কিন্তু প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির পাশেই রয়েছেন।
রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত এই শহরেও কার্ফু থাকে। কয়েক দিন আগেই ওডেসার একটা বড় অংশে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে শুনেছিলাম পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে দু’তিন দিন লেগে যেতে পারে। তবে দেখলাম, চার-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই ফের বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরে এল।
জাহাজে ভুট্টা বোঝাই করার কাজ শেষ। আজই ইউক্রেন ছেড়ে যাওয়ার পালা। গন্তব্য, সিঙ্গাপুর হয়ে চিন। জাহাজ নিয়ে আবার কখনও হয় তো এ দেশে ফিরব। আশা করি, এই সুন্দর দেশ থেকে তখন যুদ্ধের ছায়া সরে যাবে।
অনুলিখন: স্বর্ণাভ দেব