এই বিমানেই ছিলেন ফুটবলাররা। কলম্বিয়ার মেডেলিনের কাছে ধ্বংসাবশেষ। মঙ্গলবার। ছবি: এপি।
রাতটা হওয়ার কথা ছিল উৎসবের। সাম্বার। জোগা বোনিতোর।
তার বদলে এখন ফুটবল পাগল দেশটা জুড়ে শোক, অবিশ্বাস, কান্না আর প্রার্থনা। ব্রাজিল ফুটবলের এক ঝাঁক আগামীর স্বপ্ন সোমবার রাতে গুঁড়িয়ে গেছে কলম্বিয়ার পাহাড়ে।
ব্রাজিলের ফুটবল ক্লাব চাপেকোয়েনসের প্রায় পুরো ফুটবল টিম, সাপোর্ট স্টাফ এবং একগুচ্ছ সাংবাদিক বোঝাই একটি চার্টার্ড বিমান সোমবার রাত সওয়া দশটা নাগাদ ভেঙে পড়েছে কলম্বিয়ার মেডেলিনের পাহাড়ে। কোপা লিবার্তাদোরেসের পরেই লাতিন আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্লাব ফুটবল টুর্নামেন্ট কোপা সুদামেরিকানা। তারই ফাইনালের প্রথম লেগের ম্যাচ খেলতে যাচ্ছিল দল। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছনোর আগেই যান্ত্রিক গোলযোগে ভেঙে পড়ে বিমানটি। কলম্বিয়া পুলিশ জানিয়েছে, বিমানের মোট ৮১ জনের মধ্যে ৭৫ জন ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছেন। বিমানে কত জন প্লেয়ার ও সাপোর্ট স্টাফ ছিলেন, তা এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রের খবর, বিমানে চাপেকোয়েনসের অন্তত ২২ জন প্লেয়ার ছিলেন।
প্রাথমিক রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া ছ’জনের মধ্যে চার জন চাপেকোয়েনসে ফুটবলার। বাকি দু’জনের মধ্যে এক জন বিমানকর্মী ও এক জন সাংবাদিক। পরে জানা যায়, দলের দুই গোলকিপার মার্কোস দানিলো আর জ্যাকসন ফোলম্যানকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও দানিলো পরে মারা যান। তিনিই সেমিফাইনালে শেষ মুহূর্তের গোল বাঁচিয়ে দলকে ফাইনালে তুলেছিলেন। প্রাণে বেঁচেছেন হেলিও জাম্পিয়ার বলে এক ডিফেন্ডার। আর এক ডিফেন্ডার অ্যালান রুশচেল শিরদাঁড়ায় চোট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি।
ঘটনার পর, দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবল কনফেডারেশন কোপা সুদামেরিকানার ফাইনাল বাতিল করে দিয়েছে। বাতিল করা হয়েছে অন্য একাধিক খেলাও। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট মাইকেল তেমার তিন দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছেন।
আকাশে মৃত্যু
• ১৯৪৯: ইতালির তোরিনো ক্লাব। লিসবন থেকে তুরিনে ফেরার সময় পাহাড়ে বিমান ভেঙে পড়ে ১৮ জন ফুটবলার মারা যান।
• ১৯৫৮: ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড। বরফ ঢাকা মিউনিখ বিমানবন্দরে টেক অফ করার সময় দুর্ঘটনা। মৃত আট ফুটবলার ও তিন সাপোর্ট স্টাফ।
• ১৯৭৯: উজবেকিস্তানের পাখতাকোর তাসকেন্ত ক্লাব। রাশিয়ায় খেলতে গিয়ে মাঝআকাশে ২ বিমানের সংঘর্ষ।
মৃত ১৭ জন প্লেয়ার ও কোচিং স্টাফের সকলেই।
• ১৯৯৩: জাম্বিয়ার জাতীয় ফুটবল দল। বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে খেলতে যাওয়ার সময় গ্যাবনের কাছে সমুদ্রে ভেঙে পড়ে বিমান। মৃত ১৮ ফুটবলার।
সাও পাওলো থেকে স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ রওনা হয়েছিল ব্রিটিশ এরোস্পেস ১৪৬ চার্টার্ড বিমানটি। বলিভিয়ার সান্টা ক্রুজ ডে লা সিয়েরায় মাঝপথে সেটি থামে। সেখান থেকে ফের উড়ান শুরু হয় মেডেলিনের উদ্দেশে। রাত দশটার একটু আগে বিমানটি রেডার থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। তার আগে বিমানটিতে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় গোলমাল দেখা দেওয়ায় মেডেলিন বিমানবন্দর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। এর পরই বিমানটি একটি পাহাড়ে ভেঙে পড়ে। পুলিশ জানিয়েছে, বিমানটি পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা মেরে দু’টুকরো হয়ে যায়। এখনও পর্যন্ত অভিশপ্ত বিমানের ২৫ জনের দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। একে পাহাড়ি অঞ্চল তার উপর প্রচণ্ড বৃষ্টির দাপট। ফলে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে।
ক্লাবের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ম্যাচ খেলার জন্যই বিমানে উঠেছিল চাপেকোয়েনসে। ছোট্ট শহর চাপেকো থেকে বছর দুয়েক আগে দেশের ক্লাব ফুটবলের ফার্স্ট ডিভিশনে উঠে আসা চাপেকোয়েনসে দিন পাঁচেক আগেই ফুটবলে ব্রাজিলের চির প্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্তিনার ক্লাবকে ঘরের মাঠে হারিয়ে কোপা সুদামেরিকানার ফাইনালে উঠেছে। ক্লাবের ইতিহাসে স্মরণীয়তম খেলার খবর পরিবেশনের জন্য ফুটবলারদের সঙ্গী হয়েছিলেন ২২ সাংবাদিক। বুধবার ফাইনালের প্রথম লেগে কলম্বিয়ার টিম আটলেটিকো নাজিওনালের বিরুদ্ধে খেলার কথা ছিল তাদের।
দু’বছর ধরে স্বপ্নের ফর্মে গোটা দল। কোপা সুদামেরিকানার ফাইনাল। সমর্থকরা আশায় ছিলেন, কলম্বিয়ায় রাজকীয় ভাবেই শেষ হবে স্বপ্নের মরসুম। কিন্তু স্বপ্নটাই তো গুঁড়িয়ে গেল! দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর থেকে ক্লাবের স্টেডিয়ামে ভিড় করছেন সমর্থকরা। ক্লাবের ফেসবুক পেজে বলা হয়েছে, ‘‘ঈশ্বর যেন আমাদের প্লেয়ার, কর্মকর্তা, সাংবাদিক আর প্রতিনিধিদলের অতিথিদের সঙ্গে থাকেন।’’
সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে একটা ছবি। সুনসান চাপোকোয়েনসে ড্রেসিংরুম। চোট আর সাসপেনশনের সমস্যা থাকায় দলের সঙ্গে কলম্বিয়ায় না যেতে পারা তিন ফুটবলার ভেঙে পড়েছেন শূন্য ড্রেসিংরুমে।
এই দুর্ঘটনার খবরে স্তম্ভিত ফুটবল বিশ্ব। মারাদোনা থেকে নেইমার, মেসি— প্রত্যেকে শোকবার্তা জানিয়েছেন। রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা নিজেদের প্র্যাকটিস এক মিনিট থামিয়ে নীরবতা পালন করেছে। ঘটনার ধাক্কায় সান্ত্বনার ভাষা পাচ্ছে না ফাইনালে চাপোকোয়েনসের প্রতিদ্বন্দ্বী আতলেতিকো নাজিওনাল। তারা জানিয়েছে, কোপা সুদামেরিকানা ট্রফিটা যেন চাপেকোয়েনসেকে দিয়ে দেওয়া হয়।
২০০৬ থেকে ক্লাবের গোলকিপার নিভাল্ডো খবরটা শুনে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি। একটি ওয়েবসাইটকে তিনি বলেছেন, ‘‘আমি দলের সঙ্গে যাইনি। মঙ্গলবার ভোর পাঁচটায় একটা ফোন পেলাম। এক বন্ধু জানতে চাইছিল, আমি প্লেনটায় আছি কি না। তখনই সবটা শুনলাম। ’’