ব্রাজিলে ক্ষমতায় ‘ট্রপিকাল ট্রাম্প’ জাইর বোলসোনারো

এমন উত্তাপ, এমন হিংসা আগে কখনও ব্রাজিলে দেখিনি। ভোটের আগে গোটা দেশ দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল— বাম এবং অ-বামে।

Advertisement

চৈতালি চট্টোপাধ্যায়

সাও পাওলো শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৮ ০২:৪৮
Share:

নতুন প্রেসিডেন্ট: জাইর বোলসোনারো। ছবি: রয়টার্স।

লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় দেশ, কার্নিভাল-সাম্বা-ফুটবলের দেশ, আমাজনের দেশ। কত নামেই না ডাকা হয় ব্রাজিলকে। সেই দেশ এই মুহূর্তে এক ভয়ানক সময়ে দাঁড়িয়ে। চার বছর ধরে ব্রাজিলে আছি। এমন উত্তাপ, এমন হিংসা আগে কখনও দেখিনি। ভোটের আগে গোটা দেশ দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল— বাম এবং অ-বামে। লড়াইটা ছিল বাম প্রার্থী ফের্নান্দো হাদাদ বনাম প্রাক্তন সেনা-ক্যাপ্টেন, ‘ট্রপিকাল ট্রাম্প’ জাইর বোলসোনারোর মধ্যে। ভোটের ফল বলছে, ৫৫.১৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন বোলসোনারো-ই।

Advertisement

এই দুই ভোটপ্রার্থীকে কেন্দ্র করে পরিবারে, দফতরে, স্কুল-কলেজে তক্কাতক্কি লেগেই ছিল। সিনেমা হল, সঙ্গীতের অনুষ্ঠান, মিউজিয়াম— যেখানেই যেতাম, রাজনীতি ছাড়া কারও মুখে আর কোনও আলোচনা নেই। সর্বত্র মিছিল আর মিছিল। কী অসম্ভব দমবন্ধ করা পরিস্থিতি।

১৪ বছর ধরে যে ‘ওয়ার্কার্স পার্টি’ বা ‘পিটি’ ব্রাজিলের সরকারে ছিল, তাদের ঘাড়ে দুর্নীতির বোঝা! দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ সেই সরকারকে চাইছেন না। তাঁরা প্রতিবেশী দেশ ভেনেজুয়েলার তিক্ত উদাহরণ টেনে আনছেন কথায় কথায়। কিন্তু প্রশ্ন হল, পুরনো সরকারকে রুখতে বা দুর্নীতিকে দমন করতে একনায়কতন্ত্রকে কেন ডেকে আনছেন তাঁরা?

Advertisement

ফলাফল

• নতুন প্রেসিডেন্ট, প্রাক্তন সেনা-ক্যাপ্টেন ‌জাইর বোলসোনারো
• ভোট পেয়েছেন ৫৫.১৩%
• বাম প্রতিদ্বন্দ্বী, ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ফের্নান্দো হাদাদ
• ভোট পেয়েছেন ৪৪.৮৭%

• ৬৩ বছর বয়সি বোলসোনারো দায়িত্ব নেবেন ১ জানুয়ারি
• ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভক্ত। দেশে অত্যাচারী সামরিক একনায়কতন্ত্রের (১৯৬৪-৮৫) কট্টর সমর্থক
• জয়ের পরে বললেন: ‘বাইবেল এবং সংবিধান মেনে দেশ চালাব। কমিউনিজম, জনমোহিনী নীতি, সোশ্যালিজমের সঙ্গে ফ্লার্ট করব না’

জাইর বোলসোনারো উবাচ

• পুত্র সমকামী হওয়ার বদলে তারা মরে যাওয়া ভাল

• কৃষ্ণাঙ্গেরা কাজের নয়। জন্ম দিতে পারে কি না সন্দেহ

• ওকে কেউ ধর্ষণও করবে না (এক মহিলা পার্লামেন্ট সদস্যকে)

ষাটের দশকে যে সামরিক একনায়কতন্ত্র ছিল, তার অত্যাচারের কাহিনি পাওলো কোহেলো তথা কায়েতানো ভেলোসোর কলম থেকেও জানতে পারি। সেই একই রকম ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনার ঝুঁকি কেন নিচ্ছেন ব্রাজিলের মানুষ? ২০০২ সালে লুলা দা সিলভার হাত ধরে এই বামপন্থী দলের উত্থান। তারা দেশের দারিদ্রের হার কমিয়ে দিয়েছিল, কর্পোরেট দফতরে, কলকারখানায়, এমনকি পরিচারিকাদের জন্যও শক্তপোক্ত হয়েছিল শ্রমিক আইন। সে জন্যই হয়তো, পিটি সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত হলেও, ব্রাজিলের ৪৫ শতাংশ মানুষ এখনও হাদাদকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে চেয়েছেন।

এই কয়েক বছর ধরে বহু ব্রাজিলীয়ের সঙ্গে মিশে মনে হয়েছে, এঁরা বেশি দিন ধরে কোনও কিছুকেই গ্রহণ করেন না। নতুন সরকার নির্বাচনেও কি এই মনোভাবের প্রভাব পড়েছে? নতুন দলকে ক্ষমতায় আনার আর একটি কারণ সম্ভবত এই যে, দেশের অর্থনীতি একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। বোলসোনারোর দাবি, সরকার বদল হলেই বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।

অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ কিন্তু অন্য কথা বলছে। তাঁদের একাংশের মতে, দেশে শেয়ারবাজার ভাল হবে ঠিকই। কিন্তু তা সাময়িক, দীর্ঘস্থায়ী নয়। তবে ব্রাজিলীয়দের কোনও কালেই দূর ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতে দেখিনি। অর্থনীতির কথা না হয় বাদই দিলাম, বোলসোনারো ভোটে জেতার আগেই বলে দিয়েছেন, মাংসের জোগান দিতে আমাজনের গাছ কেটে গরু পালন বাড়াবেন। এই গাছ কাটায় শুধু ব্রাজিল নয়, সারা বিশ্বের পরিবেশ বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই নিয়ে আমাজনে কী লড়াই-ই না হয়েছে!

১৪ বছর ধরে সরকারে থাকা পিটি দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছে এবং বেসরকারি সংস্থাগুলির আয়কর জালিয়াতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে। ২০১৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের পর থেকে এই দুর্নীতির অভিযোগ আরও বেড়েছে। তখন সরকার অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু তারা কোনও কথাই রাখেনি বলে অভিযোগ। স্টেডিয়ামগুলো এখন তালা বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। শিক্ষাখাতে বা স্বাস্থ্যখাতের বাজেট যে তিমিরে ছিল, সেখানেই রয়ে গিয়েছে।

প্রথম রাউন্ডের ফল প্রকাশের পর থেকেই দু’দলের সমর্থকদের মধ্যে মারপিট শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন একটাই প্রার্থনা। যে ৪৪ শতাংশ ব্রাজিলীয় বামদলকে ভোট দিয়েও হেরে গিয়েছেন, তাঁরা যেন বাস্তবকে সহজে মেনে নিতে পারেন, সহিষ্ণুতা বজায় রাখেন এবং বিপদে না পড়েন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement