মঙ্গল শোভাযাত্রায় উপচে পড়া ভিড়। ছবি: বাপি রায়চৌধুরী।
ধর্মীয় মৌলবাদকে জবাব। দেশকে জঙ্গিদের ঘাঁটি বানানোর ষড়যন্ত্রীদের জবাব। বাসে আগুনে-বোমা ছুড়ে, টানা অবরোধ-হরতালে দেশকে ধ্বংসের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির ফের ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টাকেও জবাব।
জবাব দিল বাংলাদেশ। জবাব দিল ঢাকা।
রুদ্র-বৈশাখের পয়লা দিনকে আবাহনের উৎসবে মঙ্গলবার যে ভাবে প্রাণের জোয়ারে ভেসে গেলেন বাংলাদেশের মানুষ— তাতে এই মুখের মতো জবাব দেওয়ার তাগিদটাই ছিল স্পষ্ট। সাধারণ দোকানি থেকে কড়া উর্দি গায়ে অতন্দ্র নিরাপত্তারক্ষী, এমনকী দেশের তথ্যমন্ত্রী পর্যন্ত এক বাক্যে বলছেন— ঈদের মিলাদ বা দুর্গাপুজোর মতো ধর্ম-ছোঁয়া উৎসব তো বটেই, ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দিনের আবেগকেও হার মানিয়ে দিয়েছে এ বারের নববর্ষের বাংলাদেশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী অধ্যাপক, শিল্পী-সাহিত্যসেবী-সাংস্কৃতিক কর্মীরা তো ফি বছরই থাকেন। রমনা ‘বটমূল’ বলে পরিচিত হলেও সেই ডানা ছড়ানো বৃদ্ধ অশ্বত্থ বৃক্ষের আশ্রয়ে ‘ছায়ানট’-এর বাংলা বৃন্দগান। মোড়ে মোড়ে মঞ্চ বেঁধে বাউল-ফকির-লালনগীতির সঙ্গে পাক খেয়ে নাচ। রাস্তায় চোখ ধাঁধানো আলপনা, কুলোর ওপরে রক্তলাল অ্যাক্রিলিকের আলগোছে পোঁচে সাজানো তোরণ— এ সবই তো অনুষঙ্গ। এ দিন কাকভোর থেকে সব কিছুকে ছাপিয়ে গেল শুধু মানুষ, মানুষ আর মানুষ, আর তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যাপন।
তিন-তিন পুরুষ নিয়ে গোটা গোটা পরিবার নেমে এসেছে পথে। সূর্য ওঠার পালার সাক্ষী থাকতে কী সাজগোজ— প্রিয়তম পোশাকটির ওপর ফুলের আভূষণ। ঠাকুমার বাহুতে ছোট্ট নাতনি লিখে দিয়েছে, ‘স্বাগত ১৪২২’। পাল্টা নাতনির গাল বাংলাদেশের পতাকার রঙে রাঙিয়ে কপালে চুমো এঁকে দিয়েছেন ঠাকুমাও। চৈত্রের সংক্রান্তি-রাত ফুরোনোর আগেই সকলে হাত ধরাধরি করে রমনায় পৌঁছে গিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর, চারুকলা ভবন ঘুরে প্রায় তিন কিলোমিটার পায়ে হেঁটে। হাত-ব্যাগে কৌটো-বাটায় জল ঝরানো পান্তা, আর কড়া ভাজা ইলিশ-টুকরো। কারও বা ভুনা খিচুড়ি, সঙ্গে ভাজি। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ক্লান্তি নামলে কোথাও বসে খেতে খেতেই জিরিয়ে নেওয়া। তার পরেই তাড়া দেওয়া— ওঠ ওঠ মঙ্গল শোভাযাত্রা বেরিয়ে পড়বে যে!
চারুকলা ভবনের সামনে যেন রিও-র কার্নিভালের প্রস্তুতি। বাউলের ঝাঁক, রক-ব্যান্ডের দঙ্গল, জসীমউদ্দীনের পল্লী-বাংলা ছেনে বানানো ট্যাবলো, বিশালাকার সব শিল্পকর্ম বসানো গাড়ি এগিয়ে-পিছিয়ে সাজ সাজ রব।
সেনাশাসককে জবাব দিতে একদা যে মঙ্গল শোভাযাত্রা চারুশিল্পীরা শুরু করেছিলেন, আজ তা ঢাকার নববর্ষের এক প্রধান আকর্ষণ। প্রায় ৬ কিলোমিটার রাস্তার দু’পাশে লাখো মানুষ হাজির শোভাযাত্রাকে স্বাগত জানাতে।
প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আরিফুলের গালে হলুদ-সবুজে আঁকা শব্দবন্ধ— শুভ নববর্ষ ১৪২২। প্রেক্ষাপটে জনজোয়ারকে রেখে সে তার বান্ধবী নদীর একটা ছবি তুলছিল ফোন-ক্যামেরায়। বটমূলের শিল্পীরা তখন সলিল চৌধুরীর ‘ও আলোর পথযাত্রী’র সঞ্চারীতে পৌঁছে গাইছেন— ‘আহ্বান.. শোনো আহ্বান...’। রোগাসোগা নদী আজ পাটভাঙা জামদানি পরেছে, লাল-সাদা। মাথায় অবলীলায় চাপিয়ে নিয়েছে গোলাপে-গন্ধরাজে গাঁথা ফুলের বেড়। গলায় বেল ফুলের গোড়ের মালা। তারও বাজুতে রঙে আঁকা— ‘স্বাগত পহেলা বৈশাখ’! ভালবাসা-হাইফেনে গাঁথা যেন দুই দেবশিশু। হাজারো নদী-আরিফ এ দিন সকাল থেকে রাস্তায়।
বাংলাদেশ সরকার পঞ্জিকা সংস্কার করার পরে ফি বছর এই ১৪ এপ্রিলই পয়লা বৈশাখ পড়ে। সে তো ফি বছরই পড়ে, কিন্তু এ বার কেন এই বাড়তি উৎসাহ?
আরিফুলের কথায় তার কিছুটা আঁচ মেলে। বলে, ‘‘জানেন বোধ হয়, আগের সরকার এই উৎসব পছন্দ করত না। তাদের শরিক জামাতে ইসলামি তো পয়লা বৈশাখ পালন নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছিল!’’
ক্ষমতায় ফিরতে মরিয়া এখন সেই শক্তি। তিন মাস হল, বাংলাদেশের জনজীবন অস্তব্যস্ত জামাত-বিএনপি-র ডাকা লাগাতার হরতাল-অবরোধে। এক দিকে বাসে চোরাগোপ্তা পেট্রোল বোমা ছুড়ে সাধারণ মানুষকে মেরে সন্ত্রাস তৈরি করা, পাশাপাশি জোর করে ক্ষমতা দখলের নানা চক্রান্তের খবর ফাঁস হয়ে যাওয়া। সেই সব জঙ্গি-শক্তিও ফের মাথাচাড়া দিচ্ছে বাংলাদেশে, যারা ২০০১ সালে রমনার এই অনুষ্ঠানেই বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ১০ জনকে খুন করেছিল।
আজ তাদের সক্কলকে জবাব দিতেই পথে নামল আমজনতা। বিদেশমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু অবশ্য ২৪ ঘণ্টা আগেই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন এই জনজোয়ারের। বিদেশমন্ত্রীর ব্যাখ্যা, ভিড়ের আরও একটা কারণ রয়েছে। মহম্মদ কামারুজ্জামানের মতো ‘নর-পিশাচ’ রাজাকারকে দিন কয়েক আগেই ফাঁসি দিয়েছে বর্তমান সরকার। মানুষ সেই সুবিচারেরও উদ্যাপন করলেন এ বারের নববর্ষে।
উদ্যাপনেই জবাব দিলেন ওঁরা। শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম, যশোর, বরিশাল, রাজশাহি বা সিলেট— বাংলাদেশের সর্বত্রই।