ভারতের এনআরসি নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ। গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
ভারতের জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসি নিয়ে দুর্ভাবনার কিছু নেই— শেখ হাসিনাকে দেওয়া নরেন্দ্র মোদীর মৌখিক আশ্বাসেও অস্বস্তি বা উদ্বেগ কাটছে না বাংলাদেশে। তার কারণ, ভারতের শাসক দলের তাবড় নেতারা এনআরসি প্রসঙ্গে বলতে গেলেই টেনে আনছেন বাংলাদেশের নাম। এক আধবার নয়, বার বার।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জে কয়েক মিনিটের বৈঠক হয়েছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। সেখানে মোদী বলেছিলেন, ভারতের এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ২৮ সেপ্টেম্বরের সেই বৈঠক শেষে মোদীকে উদ্ধৃত করে এ কথা জানিয়েও ছিলেন বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। তিনি আরও জানিয়েছিলেন— নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। তাই এ ধরনের ইস্যু নিয়ে উদ্বেগের কিছুই নেই।
এর পর চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে দুই প্রধানমন্ত্রী নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে আর এক দফা বৈঠকে বসেন। সেই বৈঠক শেষের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, দুই প্রধানমন্ত্রী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সব দিক পর্যালোচনা করেছেন। আঞ্চলিক বিভিন্ন বিষয়ে মত বিনিময়ও করেছেন। তবে সেই বিবৃতিতে এনআরসি প্রসঙ্গে কোনও উল্লেখ ছিল না।
নরেন্দ্র মোদী এবং শেখ হাসিনার ওই বৈঠকে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সাতটি চুক্তি ও মৌ সই হয়। দুই প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন তিনটি যৌথ প্রকল্প। বিবৃতিতে ছিল রোহিঙ্গা প্রসঙ্গও। সে প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল, মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় ও মানবিক সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশ যে উদারতা দেখিয়েছে তার প্রশংসা করেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
২০ অগস্ট ঢাকা সফরকালে ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানিয়েছিলেন, অসমে এনআরসি নিয়ে যা হচ্ছে সেটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে এ কথা জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র সভাপতি অমিত শাহ ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজস্থানের জনসভায় বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ‘উইপোকা’ বলে অভিহিত করে বলেছিলেন, ‘‘ওরা ভারতীয় যুবকদের রুটিরুজি, চাকরি কেড়ে নিচ্ছে। গরিবের খাবারে ভাগ বসাচ্ছে।’’ দেশের একাধিক জায়গায় সভা করে তিনি এই অনুপ্রবেশকারী তত্ত্ব জোর গলায় প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। যে কারণে এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ উৎকণ্ঠায় আছে।
ভারতের এনআরসি নিয়ে যেমন বাংলাদেশের আলোচনাসভা, সমিতি বা সেমিনারে আলোচনা রয়েছে, তেমনই সরগরম সোশ্যাল মিডিয়াও। মোদীর বক্তব্য স্বস্তি দিলেও শঙ্কার ছায়া রয়েছে এ দেশে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রচলিত ভারত বিরোধিতার কার্ডের যে ব্যবহার, সেখানেও এনআরসি শব্দটি নিয়ে বিস্তর আলোচনাও চলছে।
এই বিয়য়ে প্রাক্তন বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত মহম্মদ শফিউল্লাহ বলেন, ‘‘অসমে এনআরসি-র কারণে আনুমানিক ১৯ লাখ বাংলা ভাষাভাষী ভারতীয়ের নাগরিকত্ব হারানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে বিপুল সংখ্যক বাংলা ভাষাভাষীকে অবৈধ বাংলাদেশি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে বলে উচ্চ মহল থেকে বিভিন্ন ভাবে প্রচার করা হচ্ছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিভিন্ন রাজ্যে এনআরসি হবে বলে ঘোষণাও করেছেন সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।’’
চলতি মাসে ভারত সফরের সময় শেখ হাসিনাকে আশ্বাস দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। জানিয়েছেন যে, এনআরসি নিয়ে বিচলিত হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু তিনি কোনও অঙ্গীকারও করেননি। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে এনআরসি নিয়ে ভারতের মৌখিক আশ্বাসে সাধারণ মানুষ ভরসা রাখতে পারছে না। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আভাস মিলতে শুরু করেছে। একমাত্র ভারতের তরফে সরকারি ঘোষণাই এ দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারে বলে মনে করছেন মহম্মদ শফিউল্লাহ।
এনআরসি প্রসঙ্গে আওয়ামি লিগের নির্বাচন পরিচালনা কার্যালয়ের সমন্বয়কারী ও দলের ডেটাবেস কার্যক্রমের প্রধান সেলিম মাহমুদ বলছেন, ‘‘বাংলাদেশের ভিতরে কিছুটা উৎকণ্ঠা থাকলেও আমার বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত ভারত এমন কিছু করবে না যা, এ দেশের জন্য ক্ষতিকর। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ভারত আর মায়ানমার এক বিষয় নয়। যে ভারত আমাদের এক কোটির বেশি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে, আমাদের হয়ে যুদ্ধ করেছে, গোটা পৃথিবীকে অবাক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মাত্র তিন মাসের মাথায় বাংলাদেশ থেকে নিজেদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে, সেই ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে, এটা আমার বিশ্বাস হয় না।’’
আরও পড়ুন: ইসকন মন্দিরে লোন উল্ফ কায়দায় জঙ্গি হানার ছক! ভারতীয় গোয়েন্দারা সতর্ক করল ঢাকাকেও
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মোহসীনের বক্তব্য, এনআরসি নিয়ে তাঁদের উদ্বেগের জায়গাটি বিভিন্ন পর্যায়ের। তাঁর মতে, রাজনীতি এবং সমাজের সাম্প্রদায়িকরণ এবং এই অঞ্চলের স্থিতিশীল অবস্থার উপর এমন ঘটনার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের আশঙ্কা রয়েছে। মোহসীনের কথায়, ‘‘মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। তাই বিজেপি নেতাদের ইসলামবিরোধী বক্তব্যের প্রভাব সেখানে কিছুটা হলেও পড়ে।’’ দ্বিতীয় বিষয় হিসেবে তিনি তুলে ধরলেন, ইসলামবিরোধী নানা বক্তব্যে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ইন্ধনদাতাদের সুযোগ করে দিতে পারে। তাঁর কথায়, ‘‘এই বিষয়টি অসহিষ্ণু চেতনাকে উস্কে দেবে এমন আশঙ্কাও থাকে।’’ তৃতীয় বিষয় হিসেবে তিনি বলছেন, ‘‘সাম্প্রদায়িকতাকে রুখে দিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিই হতে পারে অন্যতম পদক্ষেপ। কিন্তু এনআরসি-র মতো বিষয় এবং বিজেপি নেতাদের বিভিন্ন উস্কানি দেওয়া কথাবার্তা সেই সম্প্রীতিকে বিঘ্নিত করার ভয় তৈরি করছে।’’
সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার মতে, শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরের সময় নয়াদিল্লির তরফে যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে তাতে তিনি আশ্বস্ত হতে চান। তাঁর কথায়, ‘‘কারণ এই মুহূর্তে এই প্রতিবেশী দু’টি দেশ সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।’’ পাশাপাশি তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘প্রতিবেশী দেশ হিসাবে বাংলাদেশের এখনই সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে। কারণ, অমিত শাহ-সহ বিজেপি নেতারা বার বারই বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করে এই ইস্যুতে কথা বলছেন। মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১৩ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু নিয়ে বাংলাদেশ এমনিতেই এক জটিল সমস্যার মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ আশা করে, গণতান্ত্রিক ভারত তার সমস্যা তার মতো করে সমাধান করবে। বাংলাদেশের জন্য কোনও সমস্যা তৈরি করবে না তারা।’’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুভাষ সিংহ রায়ের মতে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ঘোষণা করেছিলেন, যাঁরা ছিন্নমূল হয়ে এ দেশে বাস করার জন্য এসেছেন, তারা সন্দেহাতীত ভাবে অবশ্যই ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন। যদি আইনে খামতি থাকে, সেই আইন পরিবর্তন করা হবে। তাঁর কথায়, ‘‘বর্তমান ভারত সরকার সেই ঐতিহাসিক ঘোষিত নীতির সম্পূর্ণ বিপরীতে নতুন আইন এনে সেই সব আশ্রিত মানুষদের দেশহীন করতে চাইছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষ উৎকন্ঠায় আছে।’’
আরও পড়ুন: নাগরদোলার মতো ঘুরবে মহাকাশের প্রথম হোটেল! দেখুন সেই হোটেলের অন্দরমহল