সময়টা ২০১১ সালের ২ মে। গোটা বিশ্ব চমকে গিয়েছিল ৯/১১ হামলার মূলচক্রী আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর খবর শুনে।
পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদে লুকিয়েছিলেন লাদেন। বছরের পর বছর ধরে লাদেনের গতিবিধির উপর কড়া নজরদারি চালিয়েছিল আমেরিকা। শেষ পর্যন্ত হয় আমেরিকান নেভি সিলের সফল অপারেশন ‘নেপচুন স্পিয়ার’।
লাদেনের সময় গোটা দুনিয়া জুড়ে আতঙ্কের অন্য নাম হয়ে দাঁড়িয়েছিল আল কায়দা। কিন্তু লাদেনের মৃত্যুতে জোরালো ধাক্কা খায় ওই জঙ্গি সংগঠনটি।
সেই সময়ে আল কায়দাকে কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয় ইসলামিক স্টেট অর্থাৎ আইএসআইএসের মতো জঙ্গি সংগঠনের উত্থান।
এমন একটি সন্ধিক্ষণে আল কায়দার দায়িত্ব নেন আয়মান আল জওয়াহিরি। যিনি লাদেনের জীবদ্দশায় সংগঠনে দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন।
জওয়াহিরির সময়ে আইএসআইএসের সঙ্গে আল কায়দার তিক্ততা চরমে ওঠে। আইএস প্রধান আবু বকর আল বাগদাদি নিজেকে ‘খলিফা’ ঘোষণা করলেও তা মানেনি জওয়াহিরির নেতৃত্বাধীন আল কায়দা।
আইএসআইএসের উত্থানে আল কায়দার প্রভাবে ‘ঘা’ পড়লেও জওয়াহিরি ছিলেন বিশ্বের অন্যতম ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ জঙ্গি।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় টুইন টাওয়ারে যে কুখ্যাত হামলা হয় তার অন্যতম চক্রী ছিলেন জওয়াহিরি। আমেরিকা তাঁর মাথার দাম ঘোষণা করেছিল আড়াই কোটি ডলার।
সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞদের মতে, লাদেন ছিলেন আল কায়দার মুখ। সংগঠনের ‘মেরুদণ্ড’ ছিলেন জওয়াহিরি।
আল কায়দা প্রধান সেই জওয়াহিরিই নিহত হলেন লাদেন হত্যার ঠিক ১১ বছরের মাথায়। আফগানিস্তানের মাটিতে জওয়াহিরির এই মৃত্যুকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অন্যতম সাফল্য হিসাবে দেখছে জো বাইডেনের সরকার।
লাদেনের মৃত্যু হয়েছিল পাকিস্তানে। ঘটনাচক্রে মিশরীয় জওয়াহিরির মৃত্যু হল আফগানিস্তানে। তালিবানদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল জওয়াহিরির।
ঘটনাচক্রে জওয়াহিরির মৃত্যুর বছর তিনেক আগে, ২০১৯ সালে সিরিয়ায় আমেরিকার হামলায় মৃত্যু হয় আইএসআইএস প্রধান আবু বকর আল বাগদাদিরও।
আমেরিকার প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, জওয়াহিরিকে খতম করার জন্য পরিকল্পনা বীজ বোনা হয়েছিল বছর খানেক আগে। আফগানিস্তান থেকে সেনা সরানোর সময় থেকে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা হতে থাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াশিংটনের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, জওয়াহিরির সঙ্গে আল কায়দার যে নেটওয়ার্কের সরাসরি যোগাযোগ ছিল তাদের উপর বছর খানেক আগে থেকেই নজরদারি শুরু হয়। ফলে জওয়াহিরির অবস্থানও জানা যায়।
আমেরিকার গোয়েন্দারা জানতে পারেন, আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে একটি সেফ হাউসে রয়েছেন আল কায়দা প্রধান।
জওয়াহিরি কী করেন, কী খান, কোথায় যান— গত কয়েক মাস ধরে তাঁর জীবনযাপনের উপর নজর রাখছিলেন আমেরিকার গোয়েন্দারা। এ নিয়ে ওয়াশিংটনের কর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগও রাখতেন গোয়েন্দারা।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে একের পর এক গোপন বৈঠক করেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াশিংটনেরএক আধিকারিকের কথায়, সেই সময়েই স্থির হয়ে যায় জওয়াহিরিকে খতম করার পরিকল্পনা।
জওয়াহিরি কাবুলের যে অংশে রয়েছেন, অপারেশন চলাকালীন সেখানে যাতে আরও কোনও ক্ষয়ক্ষতি না ঘটে সেই দিকটি নিয়েও আলোচনা হয় ওয়াশিংটনের ওই বৈঠকে।
গত ২৫ জুলাই আরও একটি গোপন বৈঠকে জওয়াহিরির বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর অনুমোদন দেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তবে শর্ত দেওয়া হয়, ওই অভিযানের সময় যাতে কোনও সাধারণ মানুষের মৃত্যু না ঘটে।
বৈঠকের ঠিক পঞ্চম দিনের মাথায় অর্থাৎ ৩০ জুলাই ভারতীয় সময় সকাল ৭টা বেজে ১৮ মিনিটে ড্রোনের মাধ্যমে কাবুলে অভিযান চালায় আমেরিকা।
ড্রোনে ছিল ‘হেলফায়ার’ নামে এক ধরনের বিশেষ ক্ষেপণাস্ত্র। যার আঘাতে ওই সেফ হাউসের বারান্দায় মৃত্যু হয় আল কায়দা প্রধানের।
ওই অভিযানে অবশ্য আর কোনও ক্ষয়ক্ষতি ঘটেনি বলেই দাবি করেছে আমেরিকা।
লাদেনের মৃত্যুর পর বেশ কিছু দিন চুপচাপ ছিল আল কায়দা। তার পর এক দিন আচমকাই প্রকাশ পায় জওয়াহিরির ভিডিয়ো বার্তা। ‘রক্তের বদলা রক্ত’— এমনই হুঙ্কার দিয়েছিলেন আল কায়দা প্রধান।
৯/১১ হামলার মূলচক্রীর রক্ত ঝরিয়েই নাশকতার বদলা নিল আমেরিকা। জওয়াহিরি নিহত হতেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেনের গর্বিত টুইট, ‘কত দেরি হল, সেটা বড় কথা নয়, কোথায় লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেছিল, তাতেও ফারাক পড়ে না। আমরা ঠিক খুঁজে বার করবই।’