—প্রতীকী ছবি।
নিউ জ়িল্যান্ডে আসার কয়েক মাস পরেই শুনলাম, সাধারণ নির্বাচন আসছে। এ দেশের স্থায়ী বাসিন্দা বা নাগরিক হলেই এখানে ভোট দেওয়া যায়। ভোটার হিসেবে নাম তোলাটা বাধ্যতামূলক। আমরাও ভোটার রোলে নাম-ধাম তুলে ফেললাম। বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসেই সাধারণ নির্বাচনে ভোট দেওয়াটা অভাবনীয় মনে হয়েছিল। তাই এ ব্যাপারে আমাদের আগ্রহটাও কম ছিল না।
ভোটের কয়েক দিন আগে থেকে টিভিতে রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের বিতর্কসভার বক্তব্য শুনলাম। সপ্তাহান্তে মাঝেমধ্যে লক্ষ্য করছিলাম যে, দলের সমর্থকেরা চৌরাস্তার মোড়ে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। দলীয় কর্মীরা কয়েক বার টেলিফোন করেছিলেন। বিলবোর্ড আর পোস্টারও লাগানো হয়েছিল। এ দেশে নির্বাচনের প্রচার এ-টুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকে।
পোলিং বুথে গিয়ে দেখি, ভোটার মাত্র আমরা দু’জন। নির্বাচনী আধিকারিক আমাদের নাম-ধাম ভোটার রোলে খুঁজে নিয়ে ব্যালট পেপার দিলেন। ভোট দিতে গিয়ে দেখলাম দু’জায়গায় ভোট দিতে হবে। প্রার্থীকে শুধু নয়, পার্টিকেও আলাদা করে ভোট দিতে বলা হয়েছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ভোট দেওয়া সেরে বেরিয়ে এলাম। তর্জনীতে কালির ফোঁটাটুকু পড়ল না!
ভোটারদের সুবিধার জন্য এখানে অনেক ব্যবস্থা আছে। দেশের যে কোনও বুথ থেকে ভোট দেওয়া যায়। পোস্টাল ব্যালটেরও সুবিধা আছে। ভোটের দিনটা সপ্তাহান্তে ফেলা হয়, যাতে কাজের ক্ষতি না হয়। সে দিন কোনও কারণে যাঁরা ভোট দিতে পারবেন না, তাঁদের সুবিধার জন্য ১৫ দিন আগে থেকে আগাম নির্বাচনী বুথ খোলা থাকে। অসুস্থ ভোটারদের জন্য ফোনের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।
এখানে সরকার ‘মিক্সড মেম্বার পার্লামেন্ট’ বা ‘এমএমপি’ পদ্ধতিতে গঠিত হয়। এই পদ্ধতিতে সাধারণত শুধু একটি দলের পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব হয় না। ছোট-বড় দল মিলিয়ে সরকার গঠিত হয়। আমার মতে, এই পদ্ধতি ভোটারদের পছন্দ প্রতিফলিত করার ক্ষেত্রে বেশ ভাল। এই পদ্ধতিতে প্রধান দলগুলির একচেটিয়া আধিপত্য কিছুটা এড়ানো যায়।
নির্বাচনে প্রধান চার-পাঁচটি দল ছাড়াও অনেক রাজনৈতিক দল নানা কর্মসূচি নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়ায়। যে দিন ভোট হয়, সে দিন সন্ধেবেলাতেই প্রাথমিক ফলাফল পাওয়া যায়। চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশিত হতে অবশ্য কয়েক দিন লেগে যায়।
নিউ জ়িল্যান্ড একটি ‘কনস্টিটিউশনাল মনার্কি’। বর্তমানে রাজা তৃতীয় চার্লস এই দেশের আনুষ্ঠানিক প্রধান। তাঁর প্রতিনিধি এ দেশের গভর্নর জেনারেল। তবে সরকার চালানোর দায়িত্ব থাকে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের হাতেই। ভারতের মতো এ দেশেও স্থানীয় নির্বাচন ও সাধারণ নির্বাচন হয়। স্থানীয় নির্বাচনে স্থানীয় সিটি কাউন্সিলের সদস্য, জেলা স্বাস্থ্য বোর্ডের সদস্য, স্কুলের ট্রাস্টি ও মেয়র নির্বাচন করা হয়। তিন বছর অন্তর পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে এই নির্বাচন হয়। সাধারণ নির্বাচনও হয় তিন বছর অন্তর। তিন বছর পূর্ণ হওয়ার কিছু দিন আগে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে নির্বাচন প্রক্রিয়া আরম্ভ করে দেন। গভর্নর জেনারেল আদেশপত্র পাঠিয়ে নির্বাচন কমিশনকে ভোটের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন।
ভারতে ভোটের আগে প্রতিবারই দেশের জমজমাট ভোট-আবহের কথা মনে পড়ে যায়। এ দেশে ভোটে কোনও জাঁকজমক নেই, আবার ভোট হিংসার আতঙ্কও নেই। একটাই দুঃখ— ছোটবেলায় ভোটের ফলাফলের মাঝে দূরদর্শনের সিনেমা দেখার মজাটাও এখানে পাওয়া যায় না।