অসময়ে থামলেন ভানু বসু 

কৃতী বাবার সন্তান। কম যান না নিজেও। বিশ্ব জুড়ে ওয়্যারলেস ও মোবাইল যোগাযোগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রভূত অবদান রেখে গেলেন ভানু।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৭ ০২:৫৭
Share:

মাত্র ৫২ বছর বয়সে, আচমকাই মারা গেলেন ভানু বসু। ‘পালমোনারি এম্বোলিজম’ অর্থাৎ জমাট বাঁধা রক্ত বা অন্য কিছুতে ফুসফসের ধমনী রুদ্ধ হয়ে গত শনিবার মৃত্যু হয় তাঁর।

Advertisement

কৃতী বাবার সন্তান। কম যান না নিজেও। বিশ্ব জুড়ে ওয়্যারলেস ও মোবাইল যোগাযোগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রভূত অবদান রেখে গেলেন ভানু। ভারতই হোক বা রোয়ান্ডা— প্রত্যন্ত গ্রামে সেলফোনের নেটওয়ার্ক জোগানোর ক্ষেত্রে তাঁর উদ্ভাবিত প্রযুক্তির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। অন্য সামাজিক ক্ষেত্রেও অনবদ্য কাজ করে চলেছে তাঁর সংস্থার হার্ডওয়্যার। ঝড়-বন্যা-ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিখোঁজ পরিজনদের সন্ধান পাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর রেডিওভিত্তিক প্রযুক্তি পৃথিবীর নানা প্রান্তে ব্যবহৃত হচ্ছে। পুয়ের্তো রিকোর মারিয়া ঝড়ে বিপর্যস্ত, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া মানুষজনকে খুঁজে বার করার জন্য নিখরচায় ৪০টি কেন্দ্র চলছে তাঁরই জোগানো প্রযুক্তিতে।

জন্ম সূত্রে দুই পুরুষের মার্কিন নাগরিক। শিকড়টি কিন্তু বাংলায়। ঠাকুরদা ননীগোপাল বসু ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিপ্লবী কাজকর্মের জন্য কয়েক বার জেলেও যেতে হয়। ইংরেজদের হাতে আরও নির্যাতন ও গ্রেফতারি এড়াতে ১৯২০ সালে চলে যান আমেরিকায়। তাঁর ছেলে অমরগোপাল বসুর ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ ছিল প্রযুক্তিতে। আর ছিল শিল্পোদ্যোগী হয়ে ওঠার খিদে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে, মাত্র ১৩ বছর বয়সে স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে শুরু করেন মডেল ট্রেন ও হোম রেডিও মেরামতির ব্যবসা। পরবর্তী কালে যিনি ‘বোস কর্পোরেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গড়ে তোলেন বৈদ্যুতিক শব্দ-সরঞ্জামের বিশাল ব্যবসা সাম্রাজ্য। ২০০৭-এ বিশ্বের ২৭১তম ধনী হিসেবে ফোর্বস-এর তালিকায় জায়গা করে নেন ১৮০ কোটি ডলারের সম্পদের মালিক অমরগোপাল। কে বলে বাঙালি ব্যবসা পারে না!

Advertisement

এরই পাশাপাশি অমরগোপাল অবশ্য ৪৫ বছর ধরে শিক্ষকতাও চালিয়ে গিয়েছেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি)। ভানুর পড়াশোনা সেখানেই। পরেও যুক্ত ছিলেন এমআইটি কর্পোরেশনের সঙ্গে। বিপ্লবীর নাতি, সফল ব্যবসায়ী তথা শিক্ষকের ছেলে ভানু তাঁর পরিচয় গড়ে তোলেন ‘স্পেকট্রামওয়্যার’ নিয়ে নিজের গবেষণাপত্রের ভিতে। বাবার সংস্থা বোস-এর ‘সাউন্ড সিস্টেম’ গুণমানে অসাধারণ হলেও বেশ দামি। অনেকেই মনে করেন, এ সব সকলের সাধ্যের জিনিস নয়। ভানুর অভিমুখটি ছিল ভিন্ন— কত বেশি মানুষকে মেলানো যায়, সেই লক্ষ্যেই কাজ করে গিয়েছেন তিনি।

তাঁর প্রতিষ্ঠিত লেক্সিংটনের ভানু ইনকর্পোরেশনই প্রথম সংস্থা যেটি সফটওয়্যার-ভিত্তিক রেডিও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রথম স্বীকৃতি পায় মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে। এর পরে ওয়্যারলেস ও মোবাইল ফোনে যোগাযোগের ছবিই পাল্টে দেন সৌরশক্তিতে, সামান্য বিদ্যুতে চলে— এমন সেলফোন-অ্যান্টেনার ব্যবস্থা করে। ভানুর জোগানো প্রযুক্তির দৌলতেই রোয়ান্ডার প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে ৩৭৬টি সেলুলার নেটওয়ার্ক কেন্দ্র চালু হয়েছে। ভারতের গ্রামাঞ্চলে মোবাইল ফোনের সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার যজ্ঞে সামিল হতে ২০০৫ সালে ভানু হাত মেলান ‘সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অব টেলিম্যাটিক্স’-এর সঙ্গে। টেলিযোগাযোগে উন্নতির লক্ষ্যে এটি ভারত সরকারের একটি সংস্থা। ২০০৮-এ ভারতে টেলি-পরিষেবা দেওয়ার একটি সংস্থা তাঁর প্রযুক্তি পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যবহার শুরু করে।

এমআইটি কর্পোরেশনের বোর্ড সদস্য ভানু ছিলেন আমেরিকার ‘আর্মি সায়েন্স বোর্ড’-এর সদস্য। কাজ করছিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ব্রডব্যান্ড কমিশন ফর ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট’-এর কমিশনার হিসেবেও। বাবা ‘সিনিয়র বোস’ গিয়েছেন ৪ বছর আগে, ৮৩ বছর বয়সে। রোয়ান্ডা, পুয়ের্তো রিকো থেকে ভারত— সকল প্রত্যন্তবাসীকে মোবাইল ফোনে জুড়ে দেওয়ার রাস্তা দেখিয়ে ‘জুনিয়র বোস’-এর পথ চলা থমকে গেল অসময়ে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement