আহমেদ মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত।
গজনির সুলতান থেকে শুরু করে হালের তালিবান, হিন্দুকুশের দুর্গম পাহাড় ঘেরা পঞ্জশির যেন বহিরাগতদের বধ্যভূমি। যেখানে আফগানিস্তানের ইতিহাসে কখনও রুশ, কখনও ব্রিটিশ, কখনও বা পাশতুন প্রধান তালিবানের দখলদারির ইতিবৃত্ত— সেখানে পঞ্জশির বরাবরই স্পর্ধিত ব্যতিক্রম। আজও সেখানে বীরত্বের শেষ কথা আহমেদ শাহ মাসুদ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাবার ছেড়ে যাওয়া কালাশনিকভে এখন হাত ছেলে আহমেদ মাসুদের। তাঁর উপরই এখন পঞ্জশিরকে তালিবান মুক্ত রাখার চ্যালেঞ্জ।
কিংবদন্তি আহমেদ শাহ মাসুদের ছয় সন্তানের সবচেয়ে বড় আহমেদ মাসুদ। বছর বত্রিশের হাসিখুশি সেই মাসুদই এখন পঞ্জশিরের পাশাপাশি গোটা দুনিয়ার আশা-ভরসা। তালিবানের জেট গতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাইফেল হাতে সিংহ বিক্রমে এলাকা আগলাচ্ছেন মাসুদ। তবে তিনি একা নন, অসম এই লড়াইয়ে ছোট মাসুদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আমরুল্লাহ সালেহ। তিনি আশরফ গনি সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট। সম্প্রতি তিনি নিজেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
২০০১ সালে টুইন টাওয়ার হামলার ঠিক আগে আল কায়দা ও তালিবানের যৌথ চক্রান্তের বলি হন মাসুদ সিনিয়র। জুনিয়র মাসুদের বয়স তখন মাত্র ১২। নিজের চোখে বাবাকে খুন হয়ে যেতে দেখেছেন তিনি। রাজধানী কাবুল থেকে উত্তর-পূর্বে প্রায় ১০০ কিলোমিটার গেলে পাহাড়ে ঘেরা অপরূপ পঞ্জশির। তালিবান দেশের দখল নিলেও, এখনও মুক্ত আহমেদ শাহের খাস তালুক। গোটা দেশ যখন তালিবানি আতঙ্কে থরহরি কম্প তখন কোন জাদুতে এমনটা সম্ভব হল, তার উত্তর লুকিয়ে জুনিয়র মাসুদের বেড়ে ওঠায়।
১৯৮৯ সালে পঞ্জশিরে জন্ম আহমেদ মাসুদের। ইরানের স্কুলে পড়ার পর মাসুদকে পাঠানো হয়েছিল স্যান্ডর্হাস্টে। সেখানে ব্রিটিশ সেনার অধীনে যুদ্ধবিদ্যায় প্রশিক্ষণ। ২০১৫-য় লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে ওয়ার স্টাডিজে স্নাতক হন। তার পর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্নাতকোত্তর। জীবনের বেশির ভাগ সময় বাইরে কাটালেও পঞ্জশিরকে ভোলেননি জুনিয়র মাসুদ। ভোলেননি তালিবানের হাতে বাবার মৃত্যুও।
তবে এই প্রথম নয়। ২০১৯ সালে প্রয়াত বাবার পথ ধরে আহমেদ মাসুদ একটি জোট গড়েন। নাম দেন ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট অব আফগানিস্তান। পথ প্রদর্শক বিখ্যাত নর্দার্ন অ্যালায়েন্স। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আহমেদ শাহ মাসুদ এই নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের নেতা হিসেবে প্রথমে সোভিয়েত, তার পর তালিবানের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করে গিয়েছেন। মৃত্যুও হয়েছিল আল কায়দার ঘাতকের হামলায়। এ বার লড়াইয়ে তাঁর ছেলে। সেই সময় নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের সমর্থনে দাঁড়িয়েছিল ইরান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং ভারত। ১৯৯৬ থেকে ২০০১-এর মধ্যে আফগানিস্তানে তালিবান বিরোধী আন্দোলনের চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল মাসুদের সামরিক সংগঠন।
তার পর কাবুল নদী দিয়ে বহু জল বয়ে গিয়েছে। আহমেদ শাহ মাসুদের ছেড়ে যাওয়া আসনে আজ চূড়ান্ত লড়াইয়ে নেমেছেন তাঁর ছেলে জুনিয়র মাসুদ। সম্প্রতি নিজে ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্রে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেখানে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মাসুদ লিখেছেন, ‘পঞ্জশির উপত্যকা থেকে লিখছি, আমি আমার বাবার ছেড়ে যাওয়া জুতোয় পা গলিয়ে আরও এক বার তালিবানের চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত। অস্ত্রশস্ত্র, গোলা-বারুদের কোনও অভাব নেই, কারণ বাবার সময় থেকেই আজকের দিনের জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। আমরা জানতাম এমন দিন আসবেই।’ আফগান সেনার সহায়তাও তাঁরা পাচ্ছেন বলে ওই লেখায় দাবি করেছেন জুনিয়র মাসুদ।
পঞ্জশিরকে স্বাধীন রাখতে পারবেন কি আহমেদ মাসুদ? গোটা বিশ্ব তাকিয়ে সে দিকেই।