আতঙ্ক: বিস্ফোরণের পরে লন্ডনের ‘পার্সনস গ্রিন’ স্টেশনে দিশাহারা যাত্রী।
সকাল ৮টা ২০। ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে কারও চোখ মোবাইল ফোনে ব্যস্ত তো কেউ গা এলিয়ে দিয়েছিলেন আসনে। কানে হেডফোন লাগিয়ে আধবোজা চোখে গান শুনতে ব্যস্ত ছিলেন অনেকে।
এরই মধ্যে ট্রেন সবে দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের ‘পার্সনস গ্রিন’ স্টেশনে এসে থেমেছে, হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে উঠল কামরা। চারপাশে আগুনের ঝলকানি। নিমেষে ছুটোছুটি পড়ে যায় কামরার ছোট্ট গণ্ডিতে। বিস্ফোরণে জখম হওয়ার পাশাপাশি অনেকেই পালাতে গিয়ে হুড়োহু়ড়িতে জখম হন। অন্তত ২২ জনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আহত যাত্রীদের অনেকেই বিস্ফোরণে পুড়ে যান। তবে কোনও মৃত্যুর খবর মেলেনি। চিকিৎসকদের আশ্বাস, জখমদের কারও অবস্থাই আশঙ্কাজনক নয়।
প্রাথমিক ভাবে ‘দুর্ঘটনা’ বলে জানানো হলেও পরে ঘোষণা করা হয়, এটি জঙ্গি হামলা। বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট দাবি করে, হামলার নেপথ্যে রয়েছে তারাই। সন্ত্রাস দমন দফতরের শীর্ষ কর্তা মার্ক রাউলি বলেন, ‘‘আইইডি বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে।’’ সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর আর্জি, যদি কেউ ওই দৃশ্য দেখে থাকেন, ছবি তুলে বা ভিডিও করে রাখেন, অবশ্যই যেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি ছড়িয়েছে— কামরার এক কোণে একটি বাজারের ব্যাগের মধ্যে রাখা একটি সাদা বালতি। ভিতরে থাকা কোনও দাহ্য পদার্থ দাউদাউ করে জ্বলছে। পুলিশ জানিয়েছে, ওই বালতির মধ্যেই বিস্ফোরক রাখা ছিল। তাদের সন্দেহ, আততায়ী বাড়িতেই বিস্ফোরক বানিয়েছিল।
পরিত্যক্ত এই বালতিতেই রাখা ছিল বিস্ফোরক। শুক্রবার।
‘এমআই৫’-এর সঙ্গে তদন্তে নেমেছে পুলিশ। সিসিটিভি ফুটেজ ঘেঁটে দেখা হচ্ছে, কে ওই বিস্ফোরক-ভর্তি ব্যাগটি নিয়ে ট্রেনে উঠেছিল। পার্সনস গ্রিন স্টেশনের আগে আরও পাঁচটি স্টেশনে থেমেছিল ট্রেনটি। আততায়ী ওই স্টেশনগুলির কোনও একটি দিয়েও ট্রেনে উঠতে পারে। ফলে তল্লাশি চালানো হচ্ছে সেখানেও। তবে সন্দেহ, বিস্ফোরণের সময়ে সে ট্রেনে ছিল না। আগের কোনও স্টেশনে নেমে গিয়েছিল। একটি সূত্রের অবশ্য দাবি, পুলিশ ইতিমধ্যেই আততায়ীকে চিহ্নিত করেছে।
এই নিয়ে এ বছরে পঞ্চম বার সন্ত্রাস হামলার শিকার হল ব্রিটেন। মার্চ মাসে পার্লামেন্টের কাছে ছুরি নিয়ে হামলা, দু’মাস কাটতে না কাটতেই মে-তে ম্যাঞ্চেস্টারের রক কনর্সাটে আত্মঘাতী জঙ্গি হানা। ২২ জন নিহত হন। তার পর জুন মাসেই এক বার ভ্যান নিয়ে লন্ডন ব্রিজে হামলা, আর এক বার লন্ডনের একটি মসজিদে। ফাঁড়া যেন কাটছেই না! প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে আপৎকালীন কমিটি ‘কোবরা’কে নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে বৈঠকে বসেন। পরে দেশে নিরাপত্তার মাত্রা বাড়িয়ে ‘ক্রিটিক্যাল’ করা হয়, যার মানে যে কোনও মুহূর্তে ফের হামলার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইট করেন, ‘‘আবার এক দল কাপুরুষ সন্ত্রাসবাদী হামলা চালাল লন্ডনে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের নজরেই ছিল ওই অসুস্থ মানসিকতার লোকগুলো। ওদের আগাম সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।’’ জবাবে টেরেসা বলেন, ‘‘এখনও তদন্ত চলছে। এর মধ্যে এ ধরনের মন্তব্য করলে, আর যা-ই হোক কোনও সাহায্য হয় না।’’
ঘটনার সময় ট্রেনে ছিলেন বছর ৪২-এর নাতালি বেলফোর্ড। বললেন, ‘‘ভিড়ে ঠাসা ট্রেন। কামরার যে দিকে বিস্ফোরণ ঘটে, তার উল্টো দিকটায় দাঁড়িয়ে মোবাইল ঘাঁটছিলাম। হঠাৎই বীভৎস একটা আওয়াজ। মুখে যেন আগুনের হলকা লাগল।’’ প্রাণভয়ে পালাতে যান নাতালি। কিন্তু ভিড় ট্রেনে নড়াচড়ার জায়গাই ছিল না। ধাক্কাধাক্কি পড়ে যায়।
২৩ বছর বয়সি অ্যাডাম ডেভিসও ওই কামরাতেই ছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘হঠাৎই প্রচণ্ড জোরে ঝাঁকুনি। গরম হাওয়া চোখেমুখে এসে লাগল। গোটা কামরাটা তত ক্ষণে ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছে।’’ বলতে থাকেন অ্যাডাম, ‘‘সবাই বেরোনোর চেষ্টা করছে। ভয়ে চিৎকার করছে। অনেকের গায়েই রক্ত লেগে। পায়ের তলায় চাপা পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।’’ ২৭ বছরের এমা স্টিভ স্টেশন থেকে বেরোতে গিয়ে সহ-যাত্রীদের পায়ের তলায় চাপা পড়ে যান। বললেন, ‘‘হুমড়ি খেয়ে এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলার গায়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। কোনও মতে বাঁচি! এখনও বুক কাঁপছে।’’
পাতালে-আতঙ্ক
৭ জুলাই, ২০০৫
আলাদা আলাদা তিনটি আত্মঘাতী বিস্ফোরণ তিনটি টিউবে। চতুর্থ বিস্ফোরণটি ঘটে দোতলা বাসে। নিহত হয়েছিলেন ৫২ জন। আহত সাতশোরও বেশি।
৫ ডিসেম্বর, ২০১৫
পূর্ব লন্ডনে লেটনস্টোন স্টেশনে টিউব-যাত্রীদের উপর ছুরি নিয়ে হামলা করে আততায়ী। অনেকে জখম হলেও কেউ নিহত হননি।
ছবি: রয়টার্স।