দস্তয়েভস্কির সঙ্গে ডিকেন্স।
‘বেঠোফেনের সঙ্গীত আমাকে মুগ্ধ করে কিন্তু আমি বেশি শুনতে চাই না, কারণ বেশি শুনলেই আমার মাথা ঝমঝম করে এবং আমি বিপ্লবের থেকে দূরে চলে যাই’— লেনিন
দিন ৭ নভেম্বর, ১৯১৭; স্থান পেট্রোগ্রাড, সময় দুপুর গড়িয়ে বিকেল। লেনিনের নির্দেশ অনুসারে বিপ্লবের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ বলশেভিক শ্রমিক সেনারা তখন রাইফেল উঁচিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে উইন্টার প্যালেসের দিকে। তাদের লক্ষ্য, কেরেন্সকির নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং মন্ত্রিসভার সদস্যদের কারাবন্দি করা। সের্গেই আইজেনস্টাইনের কালজয়ী ছবি ‘অক্টোবর’- এর প্রাসঙ্গিক দৃশ্যগুলি স্মরণ করুন। একটির পর একটি দুর্বল প্রতিরোধকে অতিক্রম করে শ্রমিক সেনারা সুদৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে লক্ষ্যপূরণের দিকে। তাদের শুধু মাঝেমধ্যে বিভ্রান্ত করছে প্রাসাদে সংরক্ষিত শিল্প-ঐশ্বর্যের বিপুল সম্ভার, অনুপম সব স্থাপত্য আর অবিস্মরণীয় চিত্রকার্য। ঠিক সেই সময়েই নির্দেশ এল স্বয়ং লেনিনের থেকে। লেনিন বলেছেন, “একটি শিল্পকর্ম যেন বিনষ্ট না হয় কারণ এই সম্পদ জনগণের সম্পদ।” এই ভাবেই লেনিন সৃষ্টির ঐতিহ্য ও পরম্পরার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। প্রসঙ্গত, মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের প্রথম পাঠেই বলা হয়েছে, ‘অতীতের যা কিছু সুন্দর, গ্রহণীয় এবং উপযোগী তা সব কিছুই রক্ষা করতে হবে।’
এর পর নভেম্বর বিপ্লবের সফল পরিসমাপ্তির পর সোভিয়েত রাশিয়া মেতে উঠল শিল্পসৃজনের মহোত্সবে। আইজেনস্টাইন ও পুদভকিনের চলচ্চিত্র, মায়ারহোল্ডের প্রথা ভঙ্গকারী নাট্য প্রযোজনা, গোর্কি ও গোগোলের কথাসাহিত্য, মায়াকভস্কির কবিতা— এই সব কিছুর স্ফূরণ ও বিকাশ রাশিয়াকে পরিণত করল সৃজনের পীঠস্থানে। যাঁরা শিল্পসাহিত্যের কারবারি, তাঁরা কিছুটা নির্জনতা পছন্দ করেন। এই পছন্দের কথা স্মরণে রেখেই লেনিন তাঁর অনুগামীদের বলেছিলেন, ‘‘ম্যাক্সিম গোর্কিকে বেশি বিরক্ত করো না, ওকে নিজের মতো থাকতে দাও।’’
ম্যাক্সিম গোর্কি
ঠিক এই বিপ্লব পরবর্তী সময়েই লেনিনকে প্রতিটা পদক্ষেপে সাহায্য করেছিলেন তাঁরই অনুগত শিল্পসংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক আনাতল লুনাচারস্কি। উদার রসজ্ঞ এবং সুপণ্ডিত লুনাচারস্কি বারংবার বলেছিলেন, “যারা সৃষ্টিতে নিয়োজিত তাদের উপর কোনও ফতোয়া জারি করা বিপ্লব পরিপন্থী কাজ।” এখনও লুনাচারস্কির নিবন্ধগুলি পড়লে বিস্মিত হই। আদ্যন্ত বুর্জোয়া ফরাসি কথাশিল্পী মার্সেল প্রুস্ত-এর সৃজনের কি দারুণ বিশ্লেষণ করেছেন এই প্রগাঢ় সুবোদ্ধা। তিনি বলেছিলেন, ‘‘বুর্জোয়া সমাজের অভ্যন্তরে ও হৃদয়ে প্রবেশ করেছিলেন প্রুস্ত। এই সমাজের অভিলাষ, লক্ষ্য, দৌর্বল্য, দ্বন্দ্ব কি সুচারু সূক্ষ্মতায় তিনি চিত্রায়িত করেছেন।” এক দিকে লেনিন লিখছেন তলস্তয়ের প্রশস্তি, অন্য দিকে ইউরোপের স্তম্ভস্বরূপ লেখকদের মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ করেছেন লুনাচারস্কি। সে এক অনবদ্য যুগলবন্দি। এই দু’জনকে অনুসরণ করেই গড়ে উঠেছিল, ‘সোভিয়েত স্কুল অফ লিটারারি ক্রিটিসিসম।” ভাবতে অবাক লাগে যে স্তালিনের শাসন-পর্বে এই একই প্রুস্তকে তুলোধনা করেন জাদনভ। যে সৃজনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন লেনিন ও লুনাচারস্কি, তাকেই পদদলিত করেছিলেন জাদনভ ও তাঁর একরোখা অনুগামীরা।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে লিও ট্রটস্কিকে ঘিরে, তার অবস্থান কোন দিকে ছিল। রেড আর্মির সর্বাধিনায়ক ও আদ্যন্ত বিদগ্ধ এই বিপ্লবীর সাহিত্য সৃজন সম্পর্কিত লেখাগুলি পড়লেই আমরা বুঝতে পারি তিনি কোন দিকে ছিলেন। তাঁর জন্য বলশেভিক পার্টি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছিল এবং এই যানে চেপেই তিনি রাশিয়ার একপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়াতেন প্রতিবিপ্লবীদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে এবং প্রতিক্রিয়াশীল শ্বেত-সন্ত্রাসকে দমন করতে। যাত্রার সময়ে তিনি পরিণত হতেন নিমগ্ন পড়ুয়াতে। তৎকালীন ইউরোপীয় সাহিত্যের নিদর্শনগুলি পাঠ করতেন আগ্রহ ভরে।
মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব কতটা উদার ও সূক্ষ্ম তার একটা নিরিখ আমরা পাই ট্রটস্কির লেখায়। পার্টির একগুঁয়েরা তাঁকে স্বভাবতই খুব একটা পছন্দ করতেন না। সত্যি বলতে, মহাকবি দান্তের ডিভাইন কমেডিকে ঘিরে ট্রটস্কি ও একরোখাদের জোর বিতর্ক বেধেছিল। দান্তের গভীরতা, সূক্ষ্মতা, ব্যাপ্তির উপর গুরুত্ব আরোপ করে ট্রটস্কি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন ফ্লোরেন্সের বেচাকেনা এই মহাকাব্যের বিষয় নয়। ঠিক এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন লেনিন খোলাখুলি পুশকিনের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করে। তাঁর ভাষায়, “ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির কবিতা পড়তে খুবই ভালবাসি, যদিও আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে পুশকিন পাঠই আমাকে আরও আনন্দ দেয়।” লেনিনের পুশকিন-প্রেম রোজা লুক্সেমবার্গের গোয়েট-প্রেমকে স্মরণে আনে। গোয়েটের কবিতা রোজাকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করতো। তিনি তাঁর কর্মব্যস্ত জীবনের মধ্যে বারংবার ফিরে যেতেন গোয়েটের কবিতায়।
শোস্তাকোভিচ
এই মুহূর্তে আমরা আমাদের বইয়ের শেল্ফ থেকে নামাই একটির পর একটি রত্ন— আলেকজান্ডার পুশকিনের ‘ক্যাপ্টেনের কন্যা’, টলস্টয়ের মহাকাব্যসম যুদ্ধ ও শান্তি, দস্তয়েভস্কির ‘অপরাধ ও শাস্তি’, সের্গেই ইয়েসেনিনের কবিতা। এই বই এবং অন্যান্য আরও চিরায়ত গ্রন্থ প্রকাশ করেছে মস্কোর প্রোগেস পাবলিশার্স। শক্ত বাঁধাই, মসৃণ কাগজ, ইংরেজিতে চমকপ্রদ অনুবাদ, এই সব কিছুই আমাদের অতীতে মোহিত করেছিল এবং এখনও করে। এমনকী দস্তয়েভস্কির মতো প্রবল কমিউনিস্ট বিরোধীকেও যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করেছিল সোভিয়েত জমানা। সর্বোপরি বইগুলিতে লুকিয়ে থাকত একটা বিশেষ সুবাস, এখনও সেই সুগন্ধ হারিয়ে যায়নি। এই সুগন্ধই যেন সূত্রায়িত করেছে রুশ সৃজনের বৈচিত্র্য, গভীরতা ও সূক্ষ্মতাকে। আমরা যখনই মায়াকোভস্কি, ইয়েসেনিন, আন্না আখমাটোভা-র কবিতা পড়ি, গোর্কি, বুলগাকভ ও অস্ত্রোভস্কি-র উপন্যাস পড়ি, তুর্গেনেভ-এর সংক্ষিপ্ত উপন্যাসগুলির রসাস্বাদন করি, বিশেষ করে ‘আসিয়া’, ‘বসন্ত কন্যা’ আর ‘প্রথম প্রেম’, যখন আইসেনস্টাইন-পুদেভকিনের ছবি দেখি, যখন চাইকোভস্কি ও শোস্তাকোভিচ-এর উত্তাল সঙ্গীত শুনি, তখনই লেনিন, ট্রটস্কি, লুনাচারস্কির সৃজন ব্যাখ্যা মনে আসে স্বাভাবিক নিয়মে। সৃজন ও তার মূল্যায়নের এই অমূল্য ইতিহাস শুরু হয়েছিল সেই দিনক্ষণে— ৭ নভেম্বর, ১৯১৭।