এ বার তেলেভাজা!
এত দিন তিনি বলতেন আঁকাজোকা, শিল্পকলাও এক ধরনের শিল্প। এই সে দিনই বর্ধমানে গিয়ে বলে এসেছেন কাঁথা শিল্পও এক রকমের শিল্প। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্প-তালিকায় এ বার তেলেভাজাও ঢুকে গেল। মুখ্যমন্ত্রী এ বার দাওয়াই দিলেন, কোনও শিল্পই ছোট নয়। তেলেভাজার দোকান দিয়েও জীবনে অনেক বড় হওয়া যায়।
রাজ্যের শিল্পপতি-ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদরা বারবারই বলে আসছেন, চাই উৎপাদন শিল্প। পরিষেবা ক্ষেত্রের বিকাশ। বেহাল অর্থনীতির মোড় ঘোরানোই হোক বা রাজ্যবাসীর রুটিরুজির বন্দোবস্ত করা দু’টির জন্যই নতুন কল-কারখানা গড়া, বন্ধ কারখানার দরজা খোলা একান্ত জরুরি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর নয়া শিল্পসন্ধানের তালিকায় নতুন যে সব নাম এ দিন যোগ হল, তাতে রীতিমতো হতভম্ব বণিক মহল।
শুধু তেলেভাজা নয়, মিষ্টির দোকান, কাপড়ের দোকান, চায়ের দোকান করেও যে অনেক উন্নতি করা যায়, এ দিন তা সবিস্তার ব্যাখ্যা করেন মুখ্যমন্ত্রী। হাতে গরম উদাহরণ দিয়ে বুধবার নবান্নের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমার পাড়ায় কয়েকটি তেলেভাজার দোকান আমি চিনি, যাঁরা তেলেভাজা বিক্রি করে চার-পাঁচ-দশতলা বাড়ি করেছেন। বড় ব্যবসাও করছেন। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়।”
মিষ্টির দোকানের ব্যবসায়িক সম্ভাবনা প্রসঙ্গে তাঁর যুক্তি, “এত যে লোকের সুগার হচ্ছে, কিন্তু মিষ্টি খাওয়া কি কমছে? দোকানের সব মিষ্টি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। দিনের শেষে কোনও মিষ্টিই নষ্ট হয় না। মিষ্টির দোকান করেও বড় হওয়া যায়।” আর এই দুই উদাহরণ তুলে ধরে মুখ্যমন্ত্রীর উপলব্ধি, “কোনও ব্যবসাই ছোট নয়। ছোট থেকেই বড় হতে হয়। এক বার বড় হয়ে গেলে কেউ ছোট হয় না।”
মুখ্যমন্ত্রীর এই দাওয়াই শুনে রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করলেন নবান্নের এক কর্তা। তাঁর প্রশ্ন, টিভি সিরিয়ালের ময়রা নিজের হাতযশে পরিবারের হাল ফেরাতে হয়তো পারে। কিন্তু গোটা রাজ্যের অর্থনীতি কি এতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে? আর মুখ্যমন্ত্রীর তেলেভাজা তত্ত্ব প্রসঙ্গে রাজ্যের এক বণিকসভার কর্তা বললেন, “মনে হয়, উনি বাংলায় শিল্প শব্দটির সঙ্গে ইংরেজির ‘ইন্ডাস্ট্রি’ শব্দটি গুলিয়ে ফেলছেন। তাই ওঁর কাছে সব কিছুই শিল্প মনে হচ্ছে!” মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের আর এক শিল্পপতির মন্তব্য, “কী বলব? হাস্যকর।”
অর্থনীতির শিক্ষক অভিরূপ সরকার মনে করেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কথা বলতে গিয়ে হয়তো মুখমন্ত্রী এমনটা বলে থাকতে পারেন। তবে বৃহৎ শিল্পের বিষয়টি আলাদা। এ রাজ্যে বৃহৎ শিল্পের ভবিষ্যৎ কী? অভিরূপবাবুর জবাব, “এ নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।”
অভিরূপবাবু কিছু বলতে না চাইলেও এ রাজ্যের এক শিল্পপতির প্রশ্ন, এই তো জানুয়ারি মাসে বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে ২ লক্ষ ৪৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে বলে সরকার বিজ্ঞাপন দিয়ে দাবি করেছে। গত বছর বাজেটে অর্থমন্ত্রী ৭৮ হাজার কোটি টাকা লগ্নি প্রস্তাবের কথা ঘোষণা করেছিলেন। রাজ্যে যদি এত শিল্পই আসছে, মুখ্যমন্ত্রীকে তবে দিকে দিকে তেলেভাজার দোকান দেওয়ার কথা বলতে হচ্ছে কেন?
শিল্প দফতরের সূত্র জানাচ্ছে, সরকার বড় অঙ্কের কথা বলে বিজ্ঞাপন দিলেও বাস্তবে সামান্য বিনিয়োগই হয়েছে গত তিন বছরে। বড় উৎপাদন শিল্প তো দূরের কথা মুড়ি মিল, চিঁড়ে মিল গড়ার ক্ষেত্রেও তেমন লগ্নি আসেনি কোথাও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার প্রথম বছরে সরকার এক লক্ষ ৩ হাজার কোটি টাকার লগ্নি-প্রস্তাব আসার কথা ঘোষণা করেছিল। বাস্তবে লগ্নি হয়েছিল ৩১৮ কোটি টাকা। এ নিয়ে জলঘোলা হতেই পরের বছর থেকে জেলাওয়াড়ি বিনিয়োগ তালিকা প্রকাশ করা বন্ধ করে দিয়েছে অর্থ দফতর।
মমতার শিল্পনীতি নিয়ে এমনিতে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে শিল্প-বাণিজ্য মহলে। জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে শহরাঞ্চলে জমির ঊর্ধ্বসীমা বা এসইজেড তকমা নিয়ে আপত্তি এমন নানা মৌলিক প্রশ্নেই মমতার অবস্থান বিনিয়োগ টানার পরিপন্থী বলে মনে করে বণিক মহল। সিঙ্গুরে ন্যানো বিদায়-পর্ব থেকে মমতার যে শিল্পবিরোধী ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, ক্ষমতায় আসার পরে এই কয়েক বছরে তা বেড়েছে বই কমেনি। নতুন বিনিয়োগ আসেনি, তোলাবাজি-সিন্ডিকেট রাজের দায়ে চালু শিল্পকারখানাগুলিতেও ত্রাহি রব। কিন্তু শিল্প মহল লক্ষ করেছে, মমতা যতই বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন করুন না কেন, আদতে তিনি শিল্পপতিদের কথা শোনা বা শিল্প স্থাপনের বাধা দূর করার চেয়ে গণবিনোদনের আনন্দ নিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। শিল্প আর কলাশিল্পকে যে মমতা এক করে ফেলবেন, সেটা অনেকাংশে তারই স্বাভাবিক পরিণাম বলে মনে করেন অনেকে।
সেই সঙ্গেই রাজ্যে কর্মসংস্থান এবং বৃহৎ শিল্পের অভাব নিয়ে যখনই সরকারকে বেঁধা হয়েছে, মমতা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জয়গানে মনোনিবেশ করেছেন। কখনও হস্তশিল্প, কখনও মৃৎশিল্প, কখনও কাঁথাশিল্পের প্রসারে উৎসাহ দেওয়ার কথা বলেছেন। এ দিন সেই ধারা মেনেই তেলেভাজা-মিষ্টি-ক্যারম বোর্ডের কথা এসেছে। তিন বছরের বেশি ভ্যাট দিচ্ছেন এমন ব্যবসায়ীদের জন্য অর্থ দফতর এ দিন ‘মাইক্রো বিজনেস ক্রেডিট কার্ড’ দেওয়ার প্রকল্প চালু করল। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, “এটা খুবই পজিটিভ, গঠনমূলক ভাবনা। অর্থ দফতর ও স্টেট ব্যাঙ্ক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে গ্যারেন্টার ছাড়াই ব্যবসায়ীদের ২৫ হাজার থেকে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লোন দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে।” তার পরেই মুখ্যমন্ত্রীর সংযোজন, “ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। ছোট ব্যবসা খুবই ভাল। এক জন ১০টা ব্যবসা করতে পারেন। আমি চায়ের দোকানের সঙ্গে কাপড়ের দোকান করতে পারি। সোনার দোকানও করতে পারি। এগ্রিকালচার মার্কেট করছি বলে পুকুরে মাছ চাষ করতে পারব না, তার কোনও মানে নেই। শাড়ি কিনলে চাদর ফ্রি দেয়। বড় ব্যবসা করলে ছোট ব্যবসা ফ্রি হয়।”
যদিও অর্থ দফতরের এক কর্তাই স্বীকার করলেন, কর অফিসাররা গত দু’মাস ধরে প্রায় জোরাজুরি করেই ভ্যাট ডিলারদের এই কার্ড নিতে রাজি করাচ্ছেন। এ জন্য সরকারি আদেশনামাও জারি হয়নি বলে জানাচ্ছেন বাণিজ্যকর কর্তারা। ব্যাঙ্কের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করার জন্য এই কার্ড করাতে ভ্যাট ডিলারদের চাপ দেওয়ার কথা জানালেন তাঁরাও।
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে অর্থনীতিবিদ সুমন মুখোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “সরকারের কাজ হওয়া উচিত পরিকাঠামো তৈরি করে বাজার অর্থনীতির পথে যাওয়া। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা। সেটা করতে পারলেই আসল কাজ হবে। সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না।” আর বাম জমানার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পমন্ত্রী মানব মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “এই কার্ডে কোনও লাভ হবে না। ব্যবসায়ীদের উপর আরও চাপ বাড়বে। তার চেয়ে উৎসাহ-ভাতা, ভ্যাট ও বিদ্যুৎ বিলে ছাড় দিতে পারত সরকার।”