বন্দিদের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য কলকাতা হাইকোর্ট আগেই নির্দেশ দিয়েছিল। তার পরেও প্রেসিডেন্সি জেলে দণ্ডিত বন্দি হ্যাপি সিংহ কী ভাবে খুন হল, তার তদন্ত করবে সিআইডি।
রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার বলেন, “হ্যাপি সিংহের মৃত্যুর তদন্ত আমরা সিআইডি-কে দিয়েই করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” এই ঘটনায় ওই জেলের এক রক্ষীকে সাসপেন্ড এবং এক প্রধান কারারক্ষীকে শো-কজ করেছে কারা দফতর।
এই প্রশাসনিক ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে হ্যাপি-হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত অবমাননার একটি মামলা শুরু করার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ। আজ, বুধবার আইনজীবী তাপস ভঞ্জ ওই মামলার আবেদন দায়ের করবেন। ২০১৩ সালে তাপসবাবু রাজ্যের বিভিন্ন জেলের বেহাল অবস্থার কথা জানিয়ে হাইকোর্টে জনস্বার্থের মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় তিনি বলেন, বিভিন্ন জেলে বন্দিদের নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা নেই। বহু বন্দি পালিয়ে গিয়েছে। প্রায়ই বন্দিদের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে। কিন্তু কারা-কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সে-ভাবে নজর দিচ্ছেন না। অথচ সংবিধান বন্দি, দণ্ডিতদেরও সুস্থ ভাবে বাঁচার অধিকার দিয়েছে।
ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত জুনে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ একটি রায় দিয়েছিল। সেই রায়ে বন্দিদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও কঠোর করতে বলা হয়। মঙ্গলবার তাপসবাবু সেই রায়ের প্রতিলিপি প্রধান বিচারপতির কাছে জমা দিয়ে বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশের পরেও কারা দফতর বন্দিদের নিরাপত্তা বাড়ানোর কোনও ব্যবস্থাই করেনি। সেই জন্যই জেলের মধ্যে এক জন বন্দিকে খুন হতে হল। হ্যাপি সিংহ নামে ওই বন্দির আপিল মামলা চলছে বিচারপতি নিশীথা মাত্রের ডিভিশন বেঞ্চে। এর আগে আপিল মামলায় অনেক যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দি বেকসুর খালাস পেয়েছেন। তার আপিল মামলায় কী রায় হত, তা জানার আগেই হ্যাপি খুন হয়ে গেল। প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ সব শুনে রাজ্য সরকার এবং কারা দফতরের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করার নির্দেশ দেয়।
সোমবার সকালে হ্যাপিকে খুন করা হয়। হ্যাপির আইনজীবীর অভিযোগ, পরিকল্পনা করেই তাঁর মক্কেলকে খুন করা হয়েছে। যদিও প্রেসিডেন্সি জেলে হ্যাপির সেলের সিসিটিভি-র ফুটেজ দেখার পরে কারা দফতরের কর্তাদের প্রাথমিক ধারণা, পরিকল্পিত খুন নয়, বরং মানসিক অবসাদগ্রস্ত শেখ নিজামুদ্দিন আচমকাই হত্যা করেছে হ্যাপিকে। কারা দফতরের ডিআইজি সুদীপ্ত চক্রবর্তীকে ওই ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সুদীপ্তবাবুর তদন্ত রিপোর্টেও একই কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ডিআইজি-র রিপোর্টের ভিত্তিতে এ দিনই এক জেলরক্ষীকে সাসপেন্ড করেছে কারা দফতর। রাকেশ বিশ্বাস নামের ওই রক্ষী সোমবার ভোরে ২৩ থেকে ৪৪ নম্বর সেলের দায়িত্বে ছিলেন। হ্যাপি-হত্যার সময় রাকেশবাবু ওই ওয়ার্ডের সেলগুলির তালা খুলছিলেন। ওই ওয়ার্ডের প্রধান রক্ষী ইশা আলিকেও ‘শো-কজ নোটিস’ দেওয়া হয়েছে।
জেল সূত্রের খবর, ওই সেলে লাগানো সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে, হ্যাপি যোগাসন (ডন) শেষ করে শবাসন করছিল। তখনই তার যোগাসনে ব্যবহৃত ইট হাতে তুলে নেয় নিজাম। তার পরেই সেটি ফেলে দেয় হ্যাপির মাথায়। সিসিটিভি ফুটেজে আরও দেখা যাচ্ছে, হ্যাপির মাথায় ওই ইট দিয়ে আঘাত করার পরে সেটি তুলে নিজের সেলের সামনে রেখে দেয় নিজাম। ঘটনার এক দিন পরে, মঙ্গলবারেও ময়না-তদন্ত হয়নি হ্যাপির। এক পুলিশকর্তা জানান, হ্যাপির পরিবারকে খবর দেওয়া হয়েছে। পরিবারের লোকজন না-এলে ময়না-তদন্ত হবে না।
কারা দফতরের রিপোর্টে ষড়যন্ত্রের উল্লেখ না-থাকলেও খাদিম-কর্তা পার্থ রায়বর্মণের অপহরণ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হ্যাপির মতো গুরুত্বপূর্ণ বন্দির হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কোনও রকম ঝুঁকি নিতে রাজি নয় রাজ্য সরকার। তাই হ্যাপি-হত্যার তদন্তভার সিআইডি-র হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলেন, “জেলে এ ভাবে খুন হয়ে যাওয়া সাধারণ ঘটনা নয়। সরকার তাই ঝুঁকি নিতে চায় না। সবিস্তার তদন্তের জন্যই সিআইডি-কে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
তবে কলকাতা পুলিশের আওতায় থাকা প্রেসিডেন্সি জেলে সিআইডি তদন্ত করাতে হলে কয়েকটি নিয়ম মেনে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হয় রাজ্য সরকারকে। সেই সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি এ দিন জারি করা হয়নি। আজ, বুধবারের মধ্যেই ওই বিজ্ঞপ্তি জারি হবে বলে স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর।
হ্যাপি-হত্যা মামলায় অভিযুক্ত নিজামকে জেলের মধ্যেই জেরা করতে চেয়ে কলকাতা পুলিশ এ দিন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে আবেদন করেছে। পুলিশি সূত্রের খবর, জেরা করার পরে তদন্তকারীরা নিজামকে নিজেদের হেফাজতে নেবেন।