সারদা-কাণ্ডে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে শুরু করে প্রশাসনিক ব্যর্থতা। শিল্পে দুর্দশা থেকে শিক্ষায় নৈরাজ্য। তৃণমূল তথা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বহু হাতিয়ার ছিল। রাস্তায় নেমে আন্দোলনের তৎপরতাও বাড়ছিল। অথচ নির্বাচনী মানচিত্রে অবস্থার কোনও পরিবর্তন হল না বামেদের! বরং দুই বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে ফের শোচনীয় ফলের পরে তাদের ভবিষ্যতের চলার পথ নিয়েই গুরুতর প্রশ্ন উঠল।
বামেদের জন্য দু’টি বিধানসভা কেন্দ্রের ধরন ছিল সম্পূর্ণ দু’রকমের! কলকাতার চৌরঙ্গি বরাবরের বাম-বিরোধী আসন। বামফ্রন্ট ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় আসার সময়েও ওই আসন অধরা ছিল। পুরনো চৌরঙ্গিতে এক বারই মাত্র উপনির্বাচনে বাম প্রার্থী হিসাবে জিতেছিলেন অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়। উপনির্বাচনের ফলে মঙ্গলবার দেখা যাচ্ছে, সেই চৌরঙ্গিতে সিপিএম প্রার্থী ফৈয়াজ আহমেদ খানের জামানত বাজেয়াপ্ত! অন্য কেন্দ্র বসিরহাট দক্ষিণ একটানা ৩৭ বছর ধরে ছিল বামেদের দখলে। চার মাস আগে লোকসভা ভোটে ওই আসনে বিজেপি ৩২ হাজারেরও বেশি ভোটে এগিয়ে ছিল। কিন্তু উপনির্বাচনে সেখানেও বামেদের জামানত বাজেয়াপ্ত!
ছ’বছর আগের পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে ভোটবাক্সে লাগাতার রক্তক্ষরণ দেখতে দেখতে ভবিষ্যৎ নিয়ে এ বার প্রশ্ন তুলছেন বাম কর্মী-সমর্থকদের একাংশই। তাঁদের প্রশ্ন, এক দিকে বিজেপি এবং অন্য দিকে তৃণমূল এই জোড়া বিপদের মোকাবিলা একক ভাবে কি কিছু করা সম্ভব? নাকি কংগ্রেসের মতো দলের সঙ্গে সমঝোতাই যুক্তিযুক্ত কৌশল? সিপিএমের মধ্যে এই প্রশ্নে দ্বিমত আছে। কিন্তু যা নিয়ে আর দ্বিমত নেই, তা হল নিজেদের ভোট ধরে রাখতে পারছে না বামেরা। লোকসভা নির্বাচনে বাম ভোটের একাংশ যদি বিজেপি-র দিকে গিয়ে থাকে, এ বার তা হলে গিয়েছে তৃণমূলের ঝুলিতে!
বসিরহাট দক্ষিণের উদাহরণই ধরা যাক। সেখানে এ বার তৃতীয় স্থানে শেষ করেছেন সিপিএম প্রার্থী মৃণাল চক্রবর্তী। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে ওই কেন্দ্রে বামেরা যেখানে ২১.০৫% ভোট পেয়েছিল, সেখানে এ বার মৃণালবাবু পেয়েছেন মাত্র ১৩.০৩% ভোট! অর্থাৎ বাম ভোট কমেছে প্রায় ৮%। আর তৃণমূলের ভোট লোকসভার তুলনায় বেড়েছে প্রায় ১২%। সিপিএম নেতৃত্বেরই একাংশের ধারণা, তাঁদের গ্রামীণ সংখ্যালঘু ভোটের একটা বড় অংশ আরও ভেঙে তৃণমূলের দিকে গিয়েছে। সিপিএমের রাজ্য নেতার কথায়, “বিজেপি হিন্দু ভোট এক জায়গায় আনছে। সংখ্যালঘু মানুষ নিরাপত্তার খাতিরে ভোট দিচ্ছেন রাজ্যের শাসক দলকে। বিজেপি-র অমিত শাহেরা যত সুর চড়াচ্ছেন, সংখ্যালঘুরা বুঝতে পারছেন তাঁদের রক্ষা করতে পারে শাসক দলই। আমাদের প্রচার, আন্দোলনের কোনও প্রভাব এখন ভোটে পড়ছে না!”
এ কথা ঠিক, দুই কেন্দ্রের উপনির্বাচন থেকে কোনও প্রত্যাশা রাখেনি আলিমুদ্দিন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বা রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুদের উপনির্বাচনের প্রচারে দেখাও যায়নি। সূর্যবাবু বলেছেন, এই ফল অপ্রত্যাশিত নয়। সূর্যবাবুর বক্তব্য, “তৃণমূলের পায়ের তলার মাটি খসতে শুরু করেছে। কিন্তু ওই জমি বামপন্থীরা দখল করতে না পারলে বিজেপি মাথা তুলবে। যেটা বসিরহাটে হল।” তিনি বলেন, “এই দুই উপনির্বাচনের ফল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। কারণ, বামপন্থীরা জমি দখল করতে না পারলে দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থান ঠেকানো যাবে না।”
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তীর মতে, দেশ জুড়ে বিজেপি-র হাওয়া কমছে, এটা ভাল লক্ষণ। কিন্তু এর ফায়দা একেবারেই নিতে পারছে না বামেরা। শ্যামলবাবুর কথায়, “আমাদের এখন লাগাতার চেষ্টা করতে হবে বিজেপি-র বিপদকে ঠেকিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে বামফ্রন্টের সরাসরি লড়াইয়ের জায়গায় পৌঁছনো। মানুষকে এটা বোঝানো যে, তৃণমূলের সঙ্গে লড়তে পারে বামফ্রন্টই।”