হাওয়া-বদলের শহরে এখন রাজধানীর আঁচ

কলকাতা কি দিল্লি হয়ে গেল! মার্চের শেষে মহানগরে শুকনো গরমের তেজ দেখে এই কথাটাই ঘুরছে মুখে-মুখে। ক্যালেন্ডারে চৈত্র এখন মাঝবয়সী। এই সময়ে গরম পড়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তা বলে ৪০ ছুঁই-ছুঁই! শুধু তাই নয়, সেই গরমের সঙ্গে জুড়েছে উত্তর ভারতের মতো শুকনো আবহাওয়া-ও। সব মিলিয়ে মহানগরবাসীর চোখে-নাকে-মুখে জ্বালা ধরার উপক্রম।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৪ ০২:৫৭
Share:

কলকাতা কি দিল্লি হয়ে গেল!

Advertisement

মার্চের শেষে মহানগরে শুকনো গরমের তেজ দেখে এই কথাটাই ঘুরছে মুখে-মুখে।

ক্যালেন্ডারে চৈত্র এখন মাঝবয়সী। এই সময়ে গরম পড়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তা বলে ৪০ ছুঁই-ছুঁই! শুধু তাই নয়, সেই গরমের সঙ্গে জুড়েছে উত্তর ভারতের মতো শুকনো আবহাওয়া-ও। সব মিলিয়ে মহানগরবাসীর চোখে-নাকে-মুখে জ্বালা ধরার উপক্রম।

Advertisement

কলকাতা বা তার লাগোয়া দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে শুকনো গরমের দাপট সে ভাবে দেখাই যায় না। বরং ভরা গরমে দরদর করে ঘামতেই অভ্যস্ত মহানগরী। তা হলে এ বার চৈত্রের মাঝেই এমন পরিস্থিতি কেন? বস্তুত, গত কয়েক বছর ধরে বর্ষার চরিত্র বদল এবং আবহাওয়ার পরিবর্তন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বার আবহাওয়া পরিবর্তন গ্রীষ্মেও থাবা বসাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নও পরিবেশবিদ-আবহবিজ্ঞানী মহলে ঘোরাফেরা করছে। হাওয়া অফিস সূত্রেরই খবর, গত বছর পাঁচেক ধরেই কলকাতায় মার্চের শেষেও আর্দ্রতা কম থাকছে। এ বছর অত্যধিক গরম পড়াতেই তা বেশি করে মালুম হচ্ছে।

গত কয়েক দিন ধরেই মহানগরের দিনের তাপমাত্রা ৩৬-৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে ঘোরাফেরা করছিল। শনিবার তা এক লাফে পৌঁছে গিয়েছে ৩৯.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা স্বাভাবিকের থেকে পাঁচ ডিগ্রি বেশি। হাওয়া অফিস জানিয়েছে, তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি না ছোঁয়ায় একে খাতায়-কলমে তাপপ্রবাহ বলা যাবে না। তবে গত এক দশকের নিরিখে এটাই মার্চের তৃতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা! এর আগে ২০০৬ সালের ২৬ মার্চ (৪০.৬ ডিগ্রি) এবং ২০১০ সালের ২২ মার্চ (৩৯.৬ ডিগ্রি) রয়েছে। কাকতালীয় ভাবে, ওই দু’দিনই ন্যূনতম আর্দ্রতা ছিল ২১ শতাংশ। এ দিন কলকাতায় ন্যূনতম আর্দ্রতা ছিল তার থেকে কিছুটা বেশি, ২৫ শতাংশ।

চৈত্রের মাঝামাঝি এমন চাঁদিফাটা গরমের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে ‘লু’-এর মতো গরম হাওয়াও। শনিবার দুপুরে পথেঘাটে বেরোনো লোকজন রুমাল-ওড়নায় চোখমুখ ঢেকেছেন। এ সব দেখে আবহাওয়া দফতরের এক বিজ্ঞানীর মন্তব্য, “দিল্লি কিংবা চণ্ডীগড়ের মতো শহরে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কলকাতায় এমন গরমকে স্বাভাবিক বলা যায় না।”

বস্তুত, উত্তর-পশ্চিম ভারতেও পরিচিত গরমের চরিত্রটা দেখা যাচ্ছে না। পরিষ্কার আকাশ, শুকনো গরমের বদলে সেখানে আকাশে মেঘ, কোথাও কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘলা আকাশের জন্য দিনের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে নীচে রয়েছে! মৌসম ভবনের আবহবিদেরা বলছেন, ওই এলাকায় গরমের ছবি বদলের জন্য দায়ী পশ্চিমী ঝঞ্ঝা (ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে বয়ে আসা বায়ুপ্রবাহ)। তার ফলেই বৃষ্টি-মেঘলা আকাশ। উপগ্রহ-চিত্রে ধরা পড়েছে, উত্তর-পশ্চিম ভারতের উপরে জলীয় বাষ্পের একটা আস্তরণ রয়েছে।

আবহবিদেরা বলছেন, গরম কালে এই জলীয় বাষ্পের আস্তরণটা দক্ষিণবঙ্গের উপরে দেখা যায়। কারণ, রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল এবং ঝাড়খণ্ডে তাপমাত্রা বাড়লে হাওয়া গরম হয়ে উপরে উঠে যায়। সেই শূন্যস্থান পূরণ করে বঙ্গোপসাগরের জোলো হাওয়া। “গরম হাওয়া ও জোলো হাওয়ার এই পারস্পরিক সম্পর্কেই তৈরি হয় কালবৈশাখীও,” বলছেন এক আবহবিজ্ঞানী। এ ভাবেই ২২ মার্চ কলকাতা সংলগ্ন জেলাগুলিতে ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল। গত মঙ্গলবার ঝড়বৃষ্টি হয় কলকাতাতেও। কিন্তু তার পর থেকেই কমতে থাকে আর্দ্রতা, চড়তে থাকে পারদ।

কেন বদল ঘটছে বাংলার চিরাচরিত হাওয়া-নিয়মে?

আলিপুর আবহাওয়া দফতরের ব্যাখ্যা, বঙ্গোপসাগর উপকূলে একটি উচ্চচাপ বলয় ছিল। সেই উচ্চচাপ বলয়ই দক্ষিণবঙ্গের পরিমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের জোগান দিচ্ছিল। কিন্তু দিন কয়েক আগে তা দুর্বল হয়ে পড়ে। তার ফলেই জলীয় বাষ্পের ঢোকা বন্ধ। তার ফলে আর্দ্রতা-ও কমতে থাকে। জলীয় বাষ্পের জায়গায় রাজ্যে ঢুকে পড়েছে বিহার-ঝাড়খণ্ডের শুকনো গরম হাওয়া। “এক দিকে কম আর্দ্রতা, অন্য দিকে গরম হাওয়া এই দুই কারণেই এমন শুকনো গরম মালুম হচ্ছে,” বলছেন আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ। আজ, রবিবার থেকেই রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলিতে ‘লু’ বইতে পারে বলে হাওয়া অফিস জানিয়েছে। আবহাওয়া দফতরের সঙ্গে একমত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের শিক্ষক লক্ষ্মীনারায়ণ শতপথী। তিনি বলেন, “যত দিন না নতুন করে ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হচ্ছে, তত দিন এমনটাই চলবে।”

পরিবেশবিদ ও আবহবিজ্ঞানীদের একাংশ এই শুকনো গরমকে শুধু এ বছরের ঘটনা বলে মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, এটা গত কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে। হাওয়া অফিসের তথ্যই বলছে, ২০১২-২০১৪ এই তিন বছরের ২৯ মার্চ কলকাতায় ন্যূনতম আর্দ্রতা ছিল যথাক্রমে ৩৩, ২১ ও ২৫ শতাংশ। এর নিরিখেই প্রশ্ন উঠেছে, মার্চের শেষে আর্দ্রতার পতন কি কলকাতাকে শুকনো গরমের দিকে নিয়ে যাওয়ারই ইঙ্গিত দিচ্ছে? শুধু তাই নয়, উত্তর-পশ্চিমের গরমের চরিত্র বদলকারী পশ্চিমী ঝঞ্ঝার সঙ্গে এর যোগ রয়েছে কি না, তা-ও বিশদে বোঝা প্রয়োজন বলে আবহবিদদের একাংশ মনে করেন।

গরমের চরিত্র বদল নিয়ে অবশ্য এখনই কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে নারাজ মৌসম ভবন। তাদের আবহবিজ্ঞানীদের মতে, আবহাওয়া বদল সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে ঘোষণা করতে গেলে বেশ কয়েক বছরের তথ্য দিয়ে তা প্রমাণ করতে হয়। “গত এক দশকে কলকাতায় আর্দ্রতার তথ্য কিন্তু তেমনটা নিশ্চিত করে বলছে না।”মন্তব্য এক মৌসম-কর্তার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement