দু’টি অঙ্ক। একটাই ছবি।
আয়কর এবং বিদেশি বিনিয়োগ পশ্চিমবঙ্গ কোথায় দাঁড়িয়ে? ২০১৩-’১৪ সালে এ রাজ্য থেকে আয়কর আদায় হয়েছিল আনুমানিক ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। চলতি বছরে এখনও পর্যন্ত তার পরিমাণ ১৯ হাজার ৭০০ কোটি। এর মধ্যে সিকিম এবং আন্দামানের হিসাবও ধরা আছে। ওই দুই রাজ্য বাদ গেলে শুধু পশ্চিমবঙ্গের আদায়-চিত্র আরও করুণ। অথচ এ রাজ্যের চেয়ে আয়তনে ছোট হওয়া সত্ত্বেও গুজরাতের আয়কর আদায় ঢের বেশি। আর মহারাষ্ট্রে মুম্বই তো দূরস্থান, নাগপুর-পুণের আদায়ও পশ্চিমবঙ্গকে পিছনে ফেলে দেয়।
বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও এ রাজ্যের অবস্থান অনেক নীচে। গত ১০ বছরে পশ্চিমবঙ্গে বিদেশি লগ্নি হয়েছে ১৩ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। মহারাষ্ট্রে তার পরিমাণ প্রায় ৩ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি। দিল্লি, তামিলনাডুর থেকে পিছিয়ে থাকলেও গুজরাত গত ১০ বছরে বিদেশি লগ্নি পেয়েছে প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা। সমপরিমাণ পেয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ।
বিনিয়োগের গন্তব্য হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এ রাজ্যের অবস্থান কোথায়, তা ওই দু’টি হিসাব থেকেই অনায়াসে বুঝে নেওয়া যায়। এই অসুখটা পুরনো। জমানা বদলের সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম বাড়তি উপসর্গে তার প্রকোপ বাড়ছেই। নিরাময়ের সম্ভাবনাও ক্রমশ দূরগামী।
সাধারণ ভাবে পশ্চিমবঙ্গে যে কেউ ব্যবসা করতে চান না, প্রায় অর্ধশতক ধরে এটাই বাস্তব অভিজ্ঞতা। বিধান রায়ের আমলে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে বেশ কিছু শিল্প তৈরি হয়েছিল রাজ্যে। বেসরকারি বিনিয়োগ তুলনায় কম হলেও পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা তখনও খুব নেতিবাচক ছিল না। প্রফুল্ল সেনের মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময় থেকে বাইরের বেসরকারি বড় লগ্নিকারীদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের যোগাযোগ কমতে শুরু করে। অলস, কর্মবিমুখ বাঙালির কর্মসংস্কৃতির সঙ্গে বিষয়টি বেশ মানিয়ে যেতে থাকে। এ বার আসে যুক্তফ্রন্ট। তাদের রাজত্বে যুক্ত হয় হরতাল, বন্ধ, ধর্মঘট, কলকারখানা ঘেরাওয়ের মতো বিবিধ উপকরণ। মাঝে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কংগ্রেস জমানা পেরিয়ে ফের যখন জ্যোতি বসুরা বামফ্রন্ট হয়ে ফিরে আসেন, পরিস্থিতি তত দিনে আরও সঙ্কটময়। রাজনৈতিক শক্তিতে বলীয়ান বাঙালি তখন কম্পিউটার প্রযুক্তি রুখতে বদ্ধপরিকর। আওয়াজ ওঠে ‘অটোমেশন অ্যান্টি নেশন’। এক বিদেশি ব্যাঙ্কে কম্পিউটার-বিরোধী তাণ্ডব চালিয়ে দলের কাছে রাতারাতি মহান বিপ্লবী হয়ে ওঠেন কয়েক জন। তাঁদের এক জন তো আমৃত্যু বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। এ সবের জেরে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে এ রাজ্যে বিনিয়োগ আসা তো দূরের কথা, যারা ছিল তারাও পাততাড়ি গুটিয়ে অন্যত্র চলে যেতে থাকে। ব্রিটানিয়ার মতো দু’একটি সংস্থা তাদের অফিসের ঠিকানা এখানে রেখে দিলেও কাজকারবার সরে গিয়েছে চেন্নাই, মুম্বই বা অন্য কোথাও। আবার একই ভাবে ঝাঁপ ফেলেছে ডানলপ, জেশপ, হিন্দমোটর-এর মতো আরও অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান।
এর মধ্যেই ব্যতিক্রম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। চেনা বাঙালি-চরিতের উল্টো ধারায় হেঁটে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে পশ্চিমবঙ্গকে শিল্প ও বিনিয়োগে সমৃদ্ধ করার সদর্থক চেষ্টা করেছিলেন। গড়ে ২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের রাজ্য তাঁর ছেড়ে যাওয়ার বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা লগ্নি টানতে সমর্থ হয়েছিল। তাঁরই উদ্যোগে টাটারা এ রাজ্যে গাড়ি কারখানা গড়তে আসে। তার পরের ইতিহাস সুবিদিত। শিল্প গড়তে চাওয়ার ‘অপরাধে’ বুদ্ধবাবুকে ভোটে হারিয়ে দিল বাঙালিরা।
এ বার পরিবর্তনের জমানায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে রাজ্যের লাগাম। আর বাঙালি আছে বাঙালিতেই। শুধু নিরাময়ের বদলে রোগ তার শরীরে আরও জাঁকিয়ে বসেছে। ডায়াবেটিসের রোগীকে বেশি করে চিনি খাওয়ালে যা হয়!
এই পরিস্থিতিতে রাজ্যকে লগ্নির নয়া গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরতে আজ থেকে ‘গ্লোবাল বেঙ্গল ইনভেস্টমেন্ট সামিট’-এর যে আসর বসছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করতে ক’জন শিল্পপতি আদৌ আগ্রহী হবেন, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। আসবেনই বা ক’জন? অর্থ তথা শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র সোমবারও সরাসরি তা খোলসা করতে পারেননি। রহস্যে মুড়ে উত্তর দিয়েছেন,“আর তো একটা দিন, দেখুন না।” দেশীয় শিল্পপতিদের কেউ কেউ হয়তো অমিত মিত্রের কাকুতি-মিনতি না-ও ফেরাতে পারেন। যদিও দেশের শিল্প অভিধানে পরিচিত ‘কে বা কারা’-দের সিংহভাগকেই এই সম্মেলনে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। যদি বা তেমন দু’এক জনকে দেখাও যায় তাঁদেরও মনে প্রশ্ন, এ রাজ্য কি আদৌ বাণিজ্যের অনুকূল? তোলাবাজি থেকে রাজনৈতিক সংঘর্ষ, সিন্ডিকেট রাজ থেকে নীতি বৈকল্য সবই আগের মতো। তাই কোন ভরসায় লগ্নির ঝাঁপি খোলা হবে?
একটা চোখধাঁধানো শিল্প সম্মেলন করবার কথা গত অগস্টে সিঙ্গাপুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই ঘোষণা করেছিলেন। আগামী ৭-৮ জানুয়ারির সেই শিল্প সম্মেলনেরই গালভরা নাম দেওয়া হয়েছে ‘গ্লোবাল বেঙ্গল ইনভেস্টমেন্ট সামিট’। কিন্তু শিল্প দফতর সূত্রের খবর, ‘স্বপ্নের’ সেই সম্মেলনের জন্য ‘গ্লোবাল পার্টনার’ পাওয়া তো দূরের কথা, দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিদের সিংহভাগ যে হাজির হবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। আর পুরনো কিছু লগ্নি-প্রস্তাবে নতুন মোড়ক দিয়ে কয়েকটি চুক্তির স্বাক্ষর হওয়ার কথা থাকলেও, তেমন কোনও নতুন লগ্নি ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনাও কম বলে সরকারি সূত্রের খবর।
রাজ্যের একটি বণিকসভার এক কর্তা জানাচ্ছেন, আন্তর্জাতিক শিল্প সম্মেলন করতে হলে সব সময় এক বা একাধিক দেশকে পার্টনার কান্ট্রি হিসাবে নিতে হয়। সম্মেলনে সেই দেশ লগ্নি প্রসঙ্গে নিজেদের অবস্থান জানায়। যেমন ১১-১৩ জানুয়ারি আমদাবাদে ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ শিল্প সম্মেলনে পার্টনার কান্ট্রি হয়েছে নেদারল্যান্ডস, কানাডা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান এবং আমেরিকা। সম্মেলনে প্রতিটি দেশ আলাদা আলাদা সেমিনার করে নিজেদের কথা বলবে। ২০১৪ সালের ৭-৯ অক্টোবর ‘ইনভেস্ট-মধ্যপ্রদেশ’ নামে সে রাজ্য একটি শিল্প সম্মেলন করে। সেখানেও অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চেক প্রজাতন্ত্র, মালয়শিয়া, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস, স্পেনের মতো দেশ পার্টনার কান্ট্রি ছিল।
কিন্তু এ রাজ্যের ‘গ্লোবাল বেঙ্গল ইনভেস্টমেন্ট সামিট’-এর জন্য এখনও পর্যন্ত কোনও পার্টনার কান্ট্রির নাম জানাতে পারেনি শিল্প উন্নয়ন নিগম। যদিও সম্মেলন উপলক্ষে তৈরি হওয়া কোর কমিটির এক সদস্য জানাচ্ছেন, “বড় লগ্নির প্রস্তাব নিয়ে কেউ আসছেন কি না, স্পষ্ট নয়। তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের আলোচনা সভায় চিন, জাপান, তাইওয়ান, বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, ব্রিটেনের প্রতিনিধিরা থাকবেন আশা করছি।”
অনেকেই জানেন, হাল আমলে যে কোনও প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে তোলাবাজির ‘সিঙ্গল উইনডো’ ব্যবস্থা এখন ‘মাল্টিপল উইনডো’-তে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ বাম জামানায় নেতাদের এক জায়গায় টাকা দিলেই কাজ হতো, এখন নানা নেতা-উপনেতার আবদার মেটাতে দম ছুটছে লগ্নিকারীদের। এমনিতেই রাস্তাঘাটের হাল শোচনীয়। দিল্লি-মুম্বইয়ের তুলনা টানলে কলকাতায় সড়ক-যন্ত্রণা দুর্বিষহ। তোলাবাজি আর সিন্ডিকেট রাজের দাপটে এ রাজ্যের আর্থিক কারবারের শেষ ভরসা প্রমোটারি ব্যবসাও লাটে ওঠার জোগাড়। এমনকী, কলকাতা বিমানবন্দরের বেসরকারিকরণ আটকাতে বাম আমল থেকে যে প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল, পরিবর্তনের পশ্চিমবঙ্গেও তা একই ভাবে কাজ করেছে। তাই কলকাতা বিমানবন্দরের বাইরের চেহারায় একটু চাকচিক্য ফিরলেও পরিষেবার নিরিখে দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদের তুলনায় তা অনেক পিছিয়ে।
শুধু বেসরকারি বিনিয়োগই নয়, সরকারি প্রকল্প ঘিরেও রাজনীতি অব্যাহত। যার জ্বলন্ত উদাহরণ ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো। বিদেশি ঋণে চালু একটি প্রকল্পকে কী ভাবে ভেস্তে দেওয়া যায়, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হিসাবে একে তুলে ধরছেন প্রশাসনিক কর্তারাই। রাজারহাটে ফিনান্সিয়াল হাবে এখনও কোনও উল্লেখযোগ্য লগ্নি আসেনি। জমি নীতির খেসারতও দিতে হচ্ছে বর্তমান সরকারকে। এখন তো আবার সরকারি প্রকল্পের জন্যও জমি নেওয়ার নীতি বদলে সরাসরি তা কিনে নিতে বলা হয়েছে বিভিন্ন দফতরকে। কলকাতায় এসে আদি গোদরেজ বলে গিয়েছেন, “জমি নীতি অনুকূল না হলে শিল্প আসবে কেন?” কলকাতায় এসে ফরাসি রাষ্ট্রদূত আরও এক কদম এগিয়ে বলেছেন,“এবিজি বিদায়ের স্মৃতি এখনও মোছেনি। রাজ্যে কেউ লগ্নি করার সাহস পাবে না।”
তবে তার মধ্যেই নানাবিধ পুরনো প্রকল্পের মোড়ক বদলে নতুন চুক্তি বলে দেখানোর ব্যবস্থা প্রায় পাকা। ৭ জানুয়ারি সাগর বন্দর ও জাতীয় সড়ক নির্মাণ সংক্রান্ত ৩১ হাজার কোটি টাকার চুক্তি সই করবেন কেন্দ্রীয় জাহাজ মন্ত্রী। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সেল-কে দিয়ে ইস্কোর আধুনিকীকরণ নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের পরিকল্পনা করেছে শিল্প দফতর। সই হবে দেউচা-পাচামির কয়লা খনি চুক্তিও। আর আছে আইটিসির একটি প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষর। যদিও সরকারি সূত্রের খবর, এগুলি কোনওটাই নতুন নয়।
শিল্প সম্মেলনের মঞ্চে রাজ্যের সেরা দ্রষ্টব্য তুলে ধরেই বাজিমাত করে যে কোনও সরকার। ‘গ্লোবাল বেঙ্গল সামিট’-এর আড়াই দিনের সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রীকে পাঁচ বারের জন্য হাজির করছেন অমিত মিত্র। অনুষ্ঠানসূচি দেখে বিস্মিত প্রশাসনিক ও বণিক মহলের মন্তব্য, “বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই বোধহয় শিল্পমন্ত্রীর মুখরক্ষার মাস্টার স্ট্রোক।”