পাঁচ বছরের জন্য জনপ্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত হন যিনি, নির্ধারিত সময়ের আগে কেন তাঁকে সরিয়ে নেওয়ার অধিকার থাকবে না? তৃণমূল সাংসদ তাপস পালের অশ্রাব্য ও উস্কানিমূলক বক্তৃতায় ভোটারদের মাথা হেঁট হওয়ার পরে ফের এই প্রশ্নই সামনে এসেছে।
ফিলিপিনস, ভেনেজুয়েলা, সুইৎজারল্যান্ডের মতো বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের পাশাপাশি নর্থ ডাকোটা, কালিফোর্নিয়া, উইসকনসিন-এর মতো আমেরিকার কয়েকটি স্টেটে ‘ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকার’ বা ‘রাইট টু রিকল’ আইন চালু রয়েছে। এ দেশে মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ় রাজ্যে পুরসভা এবং পঞ্চায়েতেও এমন নিয়ম রয়েছে। কী এই ‘রাইট টু রিকল’ আইন? কোনও জনপ্রতিনিধি নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে যদি সংবিধান বা আইন-বিরোধী কাজ করেন, তবে তাঁকে মেয়াদ ফুরোনোর আগেই ‘রিকল’ বা ‘ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকার’ থাকবে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের ভোটারদের। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোটার (মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ়ে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার) ‘রিকল’-এর আবেদন জানালে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের জনপ্রতিনিধিকে বাতিল করে সেখানে নতুন করে ভোটগ্রহণ করা হবে।
কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রে পর পর দু’বার নির্বাচিত হন অভিনেতা তাপস পাল। এ হেন জনপ্রতিনিধির অশালীন বক্তৃতা নিয়ে রাজ্যের গণ্ডি পেরিয়ে গোটা দেশ, এমনকী রাষ্ট্রপুঞ্জেও ধিক্কারধ্বনি উঠেছে। ১৪ জুন দু’টি সভায় তাঁর বক্তব্য রবিবার সংবাদমাধ্যমের দৌলতে প্রকাশ্যে আসে। রাজ্যে বিরোধী দল সিপিএমের কর্মী-সমর্থকদের হুমকি দিয়ে নিজে গুলি চালিয়ে খুনের কথা বলেছেন। দলের কর্মীদের পাঠিয়ে বিরোধী সমর্থক মহিলাদের ধর্ষণ করানোর হুমকিও তিনি দিয়েছেন।
মাত্র মাস দেড়েক আগে যাঁরা তাপসবাবুকে ভোট দিয়ে জিতিয়েছেন, তাঁরাই এখন সাংসদের এই ভূমিকায় লজ্জিত, ক্ষুব্ধ! কৃষ্ণনগর কেন্দ্রের অনেকেই এখন মনে করেন, সুযোগ থাকলে ভোটের বাক্সে জবাব দিতেন। কিন্তু ভারতের নির্বাচনী আইনে সে সুযোগ নেই। পাঁচ বছরের আগে নতুন করে জনপ্রতিনিধি পরিবর্তন করা যায় না। এই প্রেক্ষাপটেই ভোটারদের ‘ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকার’ আইন চালুর বিষয়টি ফের সামনে এসেছে।
ভোটে জেতার পর জনপ্রতিনিধিদের বেপরোয়াপনা নতুন নয়। কোনও সাংসদের বিরুদ্ধে ঘুষ খাওয়ার অভিযোগ ওঠে তো কেউ আবার খুন-ধর্ষণে অভিযুক্ত। এই সব কারণে ভারতে বিভিন্ন সময়ে সরকারি মহলে ‘ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকার’ আইন প্রণয়নের দাবি উঠেছে। এমনকী, নির্বাচন প্রক্রিয়া সংশোধনের সময়েও ওই আইন প্রণয়নের প্রস্তাব এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু তা হয়নি। স্বাধীনতার আগে ভগৎ সিংহ, চন্দ্রশেখর আজাদদের সংগঠন হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মির ইস্তেহারে প্রথম এই দাবি তোলা হয়। পে র জয়প্রকাশ নারায়ণও এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
এই নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও হাজারো মতামত রয়েছে। একাংশের মতে, ‘ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকার’-এর কুফলও আছে। জনপ্রতিনিধিরা সঠিক কাজের বদলে লোকপ্রিয় কাজের দিকে ঝুঁকবেন। সাংসদরা নির্বাচকমণ্ডলীকে খুশি করার কাজেই বেশি মনোযোগী হবেন। পাল্টা মত হল, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিরা আখের গুছোতে ব্যস্ত হন। সে ক্ষেত্রে এমন আইন গণতন্ত্রকে আরও শক্তপোক্ত করবে। অনেক বিশেষজ্ঞের বক্তব্য ভোটারদের যখন বেছে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হচ্ছে, তখন ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকারও থাকা উচিত।
এমন আইন হলে খুবই ভাল হয় বলে মনে করেন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “এই ব্যবস্থা নিখুঁত হওয়া দরকার। আমাদের দেশে তা প্রায় অসম্ভব।” অমলবাবুর মতে এ দেশে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে সঠিক ভাবে ভোটটাই হয় না। সেখানে ‘রিকল’ হবে কী করে! তিনি বলেন, “যে রাজ্যে এক জন সাংসদ এমন বক্তৃতা করেও অবলীলায় ঘুরে-বেড়ান, সেখানে সাধারণ মানুষের কতটুকু ক্ষমতা রয়েছে, সহজেই বোঝাই যায়!” সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, “যে সব দেশে এই আইন চালু রয়েছে, সেখানে তা অপব্যবহারেরও উদাহরণ রয়েছে।” তবে পার্থবাবুর বক্তব্য, তাপস পালের মন্তব্য নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, “এ ক্ষেত্রে ওই সাংসদের বিরুদ্ধে সরকার আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে। এমনকী, সংসদে অধিকার ভঙ্গের প্রস্তাবও আনা যেতে পারে।”
তাপস পালের ক্ষেত্রে অবশ্য কিছু করা হয়নি। দাদার-কীর্তি নিয়ে রাজ্য প্রশাসন মুখে কুলুপ এঁটেছে। কাগজে-কলমে ক্ষমা চাইয়ে দলও হাত ধুয়ে ফেলেছে। তা হলে কি ‘ফিরিয়ে নেওয়ার আইন’ ভোটারদের অস্ত্র হতে পারে? বিশেষজ্ঞদের অনেকে তা মনে করলেও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় ভাবলেশহীন। তাঁর কথায়, “এগুলো (তাপসের বক্তব্য) নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। ভোটেও এর প্রভাব পড়ে না।”